রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন - সন্দীপ চক্রবর্তীর ধারাবাহিক উপন্যাস

 আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম ।সন্দীপের নতুন উপন্যাস  প্রথম বিদুর । একেবারে এক নতুন চিন্তা ধারার প্রতিফলন।  আজ শেষ পর্ব । আগামীদিনে   সঙ্গে থাকবেন। 

প্রথম বিদুর# ৬




সন্দীপ চক্রবর্তী
বৃন্দাবন দাস যে-বাড়িতে থাকেন সেটি শ্রীমন্ত দাসের তৈরি। ভক্ত বৈষ্ণবের বাড়িতে যা যা থাকার কথা সবই আছে। রাধাকৃষ্ণের মন্দির, দোলমঞ্চ, নাটমন্দির পেরিয়ে আমরা বৈঠকখানায় প্রবেশ করলাম।
ঘরটি বেশ বড়ো। দেওয়ালে অজস্র ছবি। বেশিরভাগই অয়েল পেন্টিং। প্রতিটি ছবির নীচে, যার ছবি, তার পরিচয় লেখা। বিদুর মন দিয়ে ছবি দেখছিল।
খোকনদা বলল, 'এগুলো বৃন্দাবন কাকার পূর্বপুরুষদের ছবি। শ্রীমন্ত দাসের পর থেকে সকলের ছবি আছে।'
দেখতে দেখতে বিদুর ঘরের এক কোণে একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, 'এই ছবির নীচে পরিচয় নেই কেন?'
উঁকি দিয়ে দেখলাম এক সন্ন্যাসীর ছবি। চুলদাড়িতে মুখ প্রায় ঢাকা। কপালে রক্তচন্দনের টীকা। পোশাক তান্ত্রিকদের মতো। বৈষ্ণবের বাড়িতে তান্ত্রিকের ছবি দেখে অবাক হলাম।
বিদুর জিজ্ঞাসা করল, 'এটা কার ছবি খোকনদা?'
'উনি মধুসূদন ভারতী।'
না, খোকনদা নয়। জবাব এল ভারী গলায়। পিছন ফিরে দেখলাম একটি মাঝবয়েসি লোকের কাঁধে ভর দিয়ে ঘরে ঢুকছেন একজন সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ। অনুমানে বুঝলাম ইনিই বৃন্দাবন দাস। ওকে একটি সাবেক আরামকেদারায় বসিয়ে মাঝবয়েসি লোকটি বিদায় নিল।
খোকনদা বলল, 'এরা আমার ভায়ের বন্ধু বৃন্দাবন কাকা। বিদুর আর অমিত। কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছে।'
'তুই তো বলেছিস ওদের কথা।-- তোমাদের মধ্যে বিদুর কে? সেই তো গোয়েন্দাগিরি করছে শুনলাম।'
বিদুর লজ্জা পেয়ে বলল, 'ঠিক গোয়েন্দাগিরি নয়। আসলে ইতিহাসের মিসিং লিঙ্কগুলো খুঁজতে আমার ভালো লাগে।'
'বাহ! এক সময় আমিও খুঁজতাম। তা, কিছু পেলে?'
'পেয়েছি। তবে সেসব বলার আগে আমি আপনার কাছে দুটো প্রশ্নের উত্তর চাই।'
'বেশ তো, বলো।'
'মধুসূদন ভারতী কি গঙ্গাধরপুরের লোক ছিলেন?'
বৃন্দাবন দাস কয়েক মুহূর্ত বিদুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, 'উনি বেনারসের লোক। তবে শ্রীমন্ত দাসের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদে মাঝে মাঝে গঙ্গাধরপুরে আসতেন। এখন তুমি যদি জিজ্ঞাসা করো, একজন বৈষ্ণবের সঙ্গে ওর মতো তান্ত্রিকের কীভাবে বা কোথায় বন্ধুত্ব হয়েছিল আমি বলতে পারব না। ছোটবেলা থেকে আমরা এসব কথা শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছি।'
'মধুসূদন ভারতী কি বেনারস থেকে এসে এই বাড়িতে উঠতেন?'
'না। উনি থাকতেন কালীমন্দিরে। শুনেছি ওর দেখাশোনা করত নারান ঠাকুরের পুত্রবধূ পার্বতী।'
'আশ্চর্য! সেই সময় পার্বতীর মতো বিধবা মহিলা একজন সন্ন্যাসীর দেখাশোনা করতেন, কেউ কিছু বলত না?'
'কেন বলবে! উনি তো সন্ন্যাসী। ভোগবাসনার অনেক ঊর্ধ্বে। তা ছাড়া, গ্রামের বহু লোক তার কাছে আসত। অনেকে দীক্ষাও নিয়েছিল। পার্বতীও দীক্ষা নিয়েছিল ওর কাছে।'
বিদুর অর্থপূর্ণ হেসে বলল, 'তা হলে বোধহয় তাই হবে। এবার আপনার কাছে আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন। শুনেছি, গড়াইয়ে জোয়ার এলে সেই জল নাবালের চরা পেরিয়ে ওপরে উঠত না। আমার প্রশ্ন, গড়াইয়ে বান আসত না?'
'পূর্ণিমা-অমাবস্যায় আসত বৈকি। কিন্তু বান এলেও জল নাবালের চরা পেরিয়ে ওপরে উঠত না। তার কারণটাও খুব সহজ। আমাদের পূর্বপুরুষেরা নদীনালার দেশের মানুষ তো-- ওরা নদীর চরিত্র খুব ভালো বুঝতেন। তাই দেখবে গড়াইয়ের পাড় প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু। বানের জল এত উঁচুতে উঠতে পারত না। তবে পাড় যদি নীচু হত কিংবা নীচের দিকে যদি জল ঢোকার রাস্তা থাকত তা হলে মন্দির-টন্দির সব ডুবে যেত।'
বিদুর হঠাৎ বৃন্দাবন দাসকে প্রণাম করে বলল, 'যে দুটো জট আমি খুলতে পারছিলাম না, আপনার কথায় তা পরিস্কার হয়ে গেল।'
বৃন্দাবন দাস অবাক হয়ে বললেন, 'তা তো বুঝলাম। কিন্তু সব পরিস্কার হবার পর তুমি কী সিদ্ধান্ত নিলে সেটা তো জানা দরকার।'
বিদুর কিছুটা সংকোচের সঙ্গে বলল, 'আমার সিদ্ধান্ত আপনাদের বিশ্বাসকে আঘাত করতে পারে।'
'খোকন আমায় সব বলেছে বিদুর। আড়াইশো বছর আগের সেই রাতে মা কালীর আবির্ভাবের গল্পে তুমি বিশ্বাস করো না। এই নিয়ে অবশ্য একদিনই ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারপর তোমরা কী করেছ আমি জানি না। আমি পুরোটা শুনতে চাই।'
এই সময় সেই মাঝবয়েসি লোকটি চায়ের ট্রে আর নিমকি নিয়ে ঘরে ঢুকল। চা খেতে খেতে গল্প শুরু হল।
বিদুর প্রথমে গঙ্গাধরপুরের কালীমন্দিরের ইতিহাস শোনার পর যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিল। তারপর বলল, 'আড়াইশো বছর আগে মন্দিরে যা ঘটেছিল তার পিছনে ছিল সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনায় প্রধান ভূমিকা ছিল নারান ঠাকুর, শ্রীমন্ত দাস এবং পার্বতীর। সঙ্গে ছিল কয়েকজন বাছাই করা বিশ্বাসী গ্রামবাসী। এদের মাধ্যমেই কালীঠাকুরের আবির্ভাবের মিথ কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিরাজনারায়ণকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যার প্রয়োজন ছিল।
'গঙ্গাধরপুরের ইতিহাস শোনার পরেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, মন্দিরে জল কোথা দিয়ে ঢুকল? চার লেঠেলের মৃতদেহই বা পাওয়া গেল না কেন? এখন আমরা এর উত্তর জানি। জল ঢুকেছিল সুড়ঙ্গ দিয়ে। মন্দিরের দরজা লোহার৷ তাই প্লাবনেও ভেঙে পড়েনি। এমনকী, ভেতরের জল বাইরেও যায়নি। জলে ডুবে চারজনের মৃত্যু হবার পর তাদের মৃতদেহ গড়াইয়ের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এসব কথা আমি টুকাইয়ের ছেলেভুলনো ছড়া থেকে জানতে পারি।'
খোকনদা বলল, 'টুকাইয়ের ছড়া! মানে ওই কালীঠাকুরের ছড়া? কীরকম একটু বল।'
ছড়ার অর্থ ব্যাখ্যা করে বিদুর বলল, 'এখন প্রশ্ন হল ঘটনাটা ঠিক কীভাবে ঘটেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি একটা কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আড়াইশো বছর আগে যা ঘটেছিল তার কোনও সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স আমাদের হাতে নেই। সুতরাং আমি যেভাবে সাজিয়েছি, ঘটনাটা ঠিক সেভাবেই ঘটেছিল এরকম মনে করার কোনও কারণ নেই। কমবেশি তফাত থাকতেই পারে৷ নারান ঠাকুর এবং শ্রীমন্ত দাসের মনস্তত্ত্ব বিচার করে যা মনে হয়েছে আমি তাই বলছি।
'নারান ঠাকুর এবং শ্রীমন্ত দাস দু'জনেই চন্দনদাঁড়ির রতনকে চিনতেন। মন্দিরের গুপ্তধনের কথা ও যে জানে তাও তাদের অজানা ছিল না। নারান ঠাকুর অনুমান করেছিলেন গঙ্গাধরপুর যতই ছোট গ্রাম হোক লম্পট বিরাজনারায়ণের গ্রাস থেকে বেশিদিন বাঁচতে পারবে না। হয়েছিলও তাই। নিজে ডাকাতি না করলেও নারান ঠাকুর ডাকাত বংশের সন্তান। অন্যায়ের প্রতিকার যে তিনি সাধারণ গৃহস্থের মতো করবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং শ্রীমন্ত দাসের সঙ্গে তিনি বসলেন প্ল্যান করতে। বলা ভালো ফাঁদ পাততে।'
'ফাঁদ! কীসের ফাঁদ?'-- বৃন্দাবন দাস অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
'হ্যাঁ ফাঁদ। পার্বতীর পালকির ফাঁদ। পালকির বেহারাদের পক্ষে যে চারজন শিক্ষিত লেঠেলের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, আশা করি এ ব্যাপারে আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন। নারান ঠাকুর সুকৌশলে রটিয়ে দিয়েছিলেন ওইদিন সন্ধ্যেবেলায় পার্বতী পালকিতে ফিরবেন। কিন্তু পার্বতী পালকিতে ছিলেন না। লেঠেলরা নারান ঠাকুরের ফাঁদে পা দেয়। ওদের দেখেই বেহারারা পালিয়ে গিয়েছিল। ফাঁকা পালকি দেখে লেঠেলরা ভেবেছিল পার্বতীও পালিয়ে গেছেন। পরের দিনই ওরা নারান ঠাকুরের মন্দিরে হানা দেয়। নারান ঠাকুর এটাই চেয়েছিলেন। ফাঁদ না পাতলে তিনি এত সহজে রতনদের টেনে আনতে পারতেন না।
'নারান ঠাকুরকে শুধু বুদ্ধিমান বললে কিছুই বলা হয় না। মানুষের মনস্তত্ত্ব বিচারেও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি বুঝেছিলেন, রতনরা খালি হাতে গঙ্গাধরপুরের মেয়েদের মুক্তি দেবে না। সম্ভবত সে সময় ডাকাতে কালীর গুপ্তধনের ওপর অনেকের নজর ছিল। বিরাজনারায়ণেরও থাকতে পারে। তাই আলোচনার সময় রতন যখন গুপ্তধন দাবি করে বসল, তিনি অবাক হননি। শুধু রতনদের লোভ আরও বাড়িয়ে দেবার জন্য গুপ্তধন সম্বন্ধে কিছুই জানেন না বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতে কোনও কাজ হল না। অতঃপর নারান ঠাকুর প্রবেশ করলেন পরিকল্পনার দ্বিতীয় ভাগে। দু'দিন পর ওদের আসতে বললেন। কারণ, দু'দিন পর ছিল অমাবস্যা। অমাবস্যায় কখন গড়াইয়ে বান আসে নারান ঠাকুর ভালোই জানতেন। তাই রাত বারোটার সময় ওদের আসতে বলা হল।
'ওরা এল। নারান ঠাকুর তন্ত্রচর্চা করতেন। সুতরাং ওর মন্দিরে কারনবারি থাকা অস্বাভাবিক নয়। সম্ভবত কারনবারি খাইয়েই চার লেঠেলকে নিস্তেজ করে দেওয়া হয়েছিল। ওরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে দেখে শ্রীমন্ত দাসের সহায়তায় নারান ঠাকুর বেদীর লোহার প্লেট সরিয়ে দেন। নারান ঠাকুর শক্তিশালী পুরুষ ছিলেন। ওর স্ট্যাচু দেখেই সেটা বোঝা যায়। শ্রীমন্ত দাসও সম্ভবত যথেষ্ট শক্তি ধরতেন। কারণ যে কাজটা আমরা আজ তিনজনে মিলে করেছি, সেটাই ওরা দু'জনে করেছিলেন। প্লেট সরিয়ে ফেলার পর শ্রীমন্ত দাস মন্দির থেকে চলে যান। কিছুক্ষণ পর যখন ফিরে আসেন তখন ওর সঙ্গে গ্রামের কয়েকজন লোক। ওরা দেখতে পায় একপিঠ খোলা চুলের একটি মেয়েকে। মেয়েটি কালীপ্রতিমা হাতে বেদীর পাশের দরজা দিয়ে গড়াইয়ের পাড়ে মিলিয়ে গেল। মেয়েটি পার্বতী। পার্বতী চলে যাওয়ার পর নারান ঠাকুর মন্দিরের দুটো দরজাই বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন। সম্ভবত তার কিছুক্ষণ পর থেকেই মন্দিরে জল ঢুকতে শুরু করে। বিরাজনারায়ণের লেঠেলদের আর্ত চিৎকার শুনেও গ্রামের লোকেরা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। কারণ ওরা জানত, নারান ঠাকুর শুদ্ধাচারী তান্ত্রিক এবং গ্রামের শুভানুধ্যায়ী। তাই তিনি যা করবেন গ্রামের, বিশেষ করে গ্রামের মেয়েদের ভালোর জন্যই করবেন। আমার অনুমান, গ্রামের ওই বাছাই করা লোকেদের সঙ্গে পরামর্শ করেই নারান ঠাকুর এবং শ্রীমন্ত দাস কালীঠাকুরের আবির্ভাবের তত্ত্ব খাড়া করেন। পরে তা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে। বিরাজনারায়ণ সম্ভবত সুড়ঙ্গের কথা জানত না। এরকম একটা অতিপ্রাকৃত ঘটনার কথা শুনে সে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায়।'
বিদুর দম নেবার জন্য থামল। আমি বললাম, 'রতনও কি সুড়ঙ্গের কথা জানত না?'
'সেটা বলা মুশকিল। তবে জানলেও তা কোনও কাজে আসেনি। কারণ, এই ধরনের লোকেরা একটু আত্মম্ভরী টাইপের হয়। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থাকে তো, তাই৷ দু'জন প্রৌঢ় ওদের মেরে ফেলার প্ল্যান করতে পারে, সেটা বোঝার মতো কল্পনাশক্তি রতনের ছিল না। থাকলে রাত বারোটার সময় দেখা করতে যেত না।'
বৃন্দাবন দাস এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলেন। এবার তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, 'তুমি কিন্তু একজনের কথা এখনও বলোনি। নারান ঠাকুরের কী হল?'
বিদুর রহস্যময় হেসে বলল, 'বিরাজনারায়ণের কোপ থেকে বাঁঁচবার জন্য ওকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ শ্রীমন্ত দাসই দিয়েছিলেন। তিনিই বেনারসে আশ্রম করে দেন। নারান ঠাকুর সেখানে থাকতেন। অনেক বছর পর শ্রীমন্ত দাসের অতিথি হয়ে তিনি গঙ্গাধরপুরে ফেরেন। তখন তিনি আর নারান ঠাকুর নন, মধুসূদন ভারতী।'
ঘরে আলপিন পড়লে বোধহয় তার শব্দ শুনতে পাওয়া যাবে। খোকনদার চোখদুটো ফুটবলের মতো হয়ে গেছে। বৃন্দাবন দাসও শ্রদ্ধা আর বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে বিদুরের দিকে তাকিয়ে আছেন।
বিদুর বলল, 'নতুন মন্দিরের সামনে নারান ঠাকুরের যে স্ট্যাচু আছে তার সঙ্গে মধুসূদন ভারতীর এই ছবি মেলালে স্পষ্ট বোঝা যায় নারান ঠাকুর আর মধুসূদন ভারতী একই ব্যক্তি। যতই চুলদাড়িতে মুখের অর্ধেকটা ঢেকে ফেলুন, নাক চোখ ঠোঁটের গড়ন তো আর বদলানো যায় না।'
'তুমি শিয়োর, নারান ঠাকুর আর মধুসূদন ভারতী একই লোক?' বৃন্দাবন দাস জিজ্ঞাসা করলেন৷
'ছবি দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলাম। পরে আপনি যখন ওর পরিচয় দিলেন তখন নিশ্চিত হই। পূর্ব পরিচয় না থাকলে পার্বতীর মতো একজন গ্রাম্য গৃহবধূর পক্ষে মধুসূদন ভারতীর দেখাশোনা করা সম্ভব হত না। ওর সংস্কারে বাধত। শ্রীমন্ত দাসও ওকে অনুরোধ করতে পারতেন না।'
বৃন্দাবন দাস একদম চুপ করে গেলেন। মনে হল তিনি বোধহয় এই ঘরে নেই। অন্য কোনও জগতে বিচরণ করছেন।
বিদুর বলল, 'আমি জানি আপনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন। আপনাদের এতদিনের ধারণা আজ ভেঙে গেল।'
'না বিদুর। সেজন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি না। তুমি যেভাবে ঘটনাটা সাজিয়েছ তাতে যুক্তি আছে৷ মানা-না-মানা যে-যার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমরা কেন তোমার মতো যুক্তিসঙ্গত ভাবে বিচার করতে পারলাম না? কেন একটা মনগড়া তত্ত্বে আটকে রইলাম?'
'সেটা বোধহয় আপনারা একটা প্রিডিটারমাইন্ড কনসেপ্ট নিয়ে বড়ো হয়েছেন বলে। যার বাইরে যাবার স্বাধীনতা আপনাদের দেওয়া হয়নি। আমি বাইরে থেকে এসেছি। তাই খোলা মনে সব দেখতে পেরেছি।'
বৃন্দাবন দাসকে প্রণাম করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। গঙ্গাধরপুরের রাস্তা এরই মধ্যে বেশ ফাঁকা হয়ে গেছে। কাল চলে যাব। তাই মন্দিরে মা'কে দর্শন করার ইচ্ছে হল। খোকনদাও এককথায় রাজি।
মন্দিরে আরতি দেখে ফেরার সময় খোকনদা বলল, 'একটা প্রশ্ন আছে বিদুর। গুপ্তধনের কী হল?"
'সম্ভবত যেখানে ছিল সেখানেই আছে।'
কৌতূহল সামলাতে না পেরে বললাম, 'কোথায় রে! তুই জানিস?'
'কেন রে! গুপ্তধন খুঁজতে যাবি নাকি?' বলেই বিদুর দাঁড়াল। আমরা মন্দির থেকে খানিক দূরে চলে এসেছিলাম। বিদুরের ইশারায় ফিরে গেলাম মন্দিরের কাছে। বিদুর নারান ঠাকুরের স্ট্যাচুর কাছে থামল৷ মন্দিরের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠল ঊনবিংশ শতকের এক ব্রাহ্মণের বলিষ্ঠ প্রতিরূপ। স্ট্যাচুর নীচের বেদীটার দিকে আঙুল তুলে বিদুর বলল, 'এটার বিশাল সাইজ দেখে তোমাদের সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল খোকনদা। বিশেষ করে বেদীর তুলনায় স্ট্যাচুটা যেখানে চোখে পড়ার মতো ছোট। অমিত বোধহয় লক্ষ করেছিল কিন্তু তলিয়ে ভাবেনি। আমার বিশ্বাস, এই বেদীর ভেতর একটা সিন্দুক জাতীয় কিছু পাওয়া যাবে। তাতেই আছে তোমার গুপ্তধন। তবে--'
'তবে কী বিদুর?' খোকনদা জিজ্ঞাসা করল।
'ডাকাতি করা ধন খোকনদা। বহু মানুষের চোখের জল আর দীর্ঘশ্বাস ওর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ওসব নিয়ে এখন আর না ভাবাই ভালো।'
বিদুর আবার হাঁটতে শুরু করল। আমরা ওকে অনুসরণ করলাম। রাস্তায় আর কোনও কথা হল না। বিদুরের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে নারান কুটীরে পৌঁছে গেলাম।
(শেষ)

মন্তব্যসমূহ