২০২১ এর নির্বাচনের রাজনীতির ময়দানে মহারাজ সৌরভ , কোন ইনিংস খেলতে আসছেন ?

বিশেষ নিবন্ধঃ


সৌজন্য সাক্ষাতের ইনিংস শেষের খেলাটা কী 




কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৩০ ডিসেম্বর


বছরের শেষ রবিবারের শেষবেলাতে। 

সৌজন্য সাক্ষাত তাও আবার নাগাড়ে দুঘণ্টার।

তবে মহারাজা যখন বলছেন, না মেনে উপায় কী? রাজ্যপাল জগদীপ ধনখরের সঙ্গে সৌরভ গাঙ্গুলির সৌজন্য সাক্ষাত। এরপর কমবেশি বারো ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই, সোমবার সকালে দিল্লি উড়ে গেলেন মহারাজ। সেখানে একই অনুষ্ঠানে দেখা গেলো কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সৌরভ গাঙ্গুলিকে। এরপরেও কিছু বলা চলবে না। কারণ মহারাজ বলে দিয়েছেন- "কিছু স্পেকুলেট করো না।" রবিবার রাজ্যপাল ভবন থেকে বেরিয়ে তাঁর পরিচিত ঢংয়ে হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন সৌরভ- "কেন, আমি কি কারুর সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারি না?" দিল্লি উড়ে যাওয়ার আগেও তাঁর গলায় একই সুর।



এর আগেও ওরকম সৌজন্য সাক্ষাত করতে নবান্নে গেছিলেন সৌরভ।

গত অগাস্ট মাসের কথা। নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান সৌরভ। সেদিনও তিনি জানিয়েছিলেন, সৌজন্য সাক্ষাত। পরে সাংবাদিকদের গোয়েন্দাগিরিতে অন্য ঘটনার কথা বেরিয়ে আসে। 'গাঙ্গুলি এডুকেশন অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি'র জন্য রাজ্য সরকারের দেওয়া, দু'একর জমি ফেরত দিতে চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন সৌরভ। সেই ঘটনা নিয়েও কিছুদিন বাঙালির চায়ের কাপে ঝড় ওঠে। তবে মুখ্যমন্ত্রী বা সৌরভ সেব্যাপারে প্রকাশ্যে মুখ না খোলায়, অল্পদিনেই যাবতীয় জল্পনা কল্পনার মাথায় ঠান্ডা জল ঢালা হয়ে যায়। 


অগাস্ট মাসের পর এবার ডিসেম্বরে ফের সৌজন্য সাক্ষাত করতে দেখা গেলো বাংলার মহারাজাকে। তাঁকে নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই মিডিয়ার। সৌরভই যেন বাংলা জয়ের তুরূপের তাস। শুভেন্দু অভিষেকরা যতোই তর্কযুদ্ধে মাতুক না কেন, বাংলার আইকন কে তা নিয়ে কোনও তর্ক নেই। সুতরাং সৌরভের গতিবিধি নিয়ে 'ব্রেকিং নিউজ' করতে সব মিডিয়া নজরদারি করেই চলেছে।


রাজনীতিতে সৌরভ। ব্যাপারটা নিয়ে অনেকদিন ধরেই জলঘোলা চলেছে। বাম জমানাতেও এমন কথা শোনা যেতো না, তা নয়। মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিলো মহারাজের। সেই সম্পর্কে রাজনীতির রং লাগা নিয়ে বিস্তর গবেষনা চালিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, সম্পর্কটা ছিলো একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেই।

এক শহরের বাসিন্দা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর দেশের ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি। দুজনেই স্বমহিমায় খ্যাত। স্বাভাবিকভাবে শহরের নানা অনুষ্ঠানে এই দুজন মুখোমুখী হতেই পারেন। আবার কোনও প্রসঙ্গে একজনের কথায়, আর একজন ঢুকে পড়তেও পারেন। কিন্তু এরকম কিছু ঘটলেই, মানুষ রাজনীতির গন্ধ পেতে শুরু করেন। 


একই ঘটনা দেখা গেছিলো সৌরভ গাঙ্গুলি দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতির কুর্সিতে বসার পর। সেখানে তখন সচিব জয় শাহ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে। কোথাও এক বোঝাপড়ার খেলা আবিষ্কার করে বসলো বাঙালি। ওদিকে সৌরভ তখন ব্যস্ত দিনরাতের টেস্ট ম্যাচ চালু করা, আইপিএল থেকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছেঁটে ফেলার মতো একের পর আর এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিতে। 


এরপর বাংলার ঢাকে নির্বাচনের কাঠি পড়তেই, বিরোধীরা বিজেপির কাছে দলের মুখ দেখতে চাইলেন। আর এই বিরোধীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রথম নামটি জোড়াফুল শিবিরের। আর এব্যাপারে তৃণমূল কংগ্রেসের মূল ভরসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো কোনও মুখ, এমুহূর্তে পদ্ম শিবিরের হাতে নেই। তবে বিরোধীদের জবাব দিতে অমিত শাহর অভয়বাণী, বাংলার ভূমিপুত্রই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। ওদিকে শুভেন্দুও বলে চলেছেন, সবেতো ট্রেলার শুরু। সিনেমা এখনও বাকী আছে। 


এখানেই ফের আর এক রহস্যের শুরু। কে সেই বঙ্গসন্তান? সিনেমার ক্লাইম্যাক্সে কার মুখ দেখা যাবে? বিজেপি শিবিরের কারুর মুখে সরাসরি সৌরভের নাম শোনা না গেলেও, সবমিলিয়ে ফের সেই রহস্য। টানটান উত্তেজনা। এই পরিস্থিতির মধ্যে সৌরভের রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া। তাও আবার ঝাড়া দুঘণ্টার। বাংলার রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক মহলে এই সৌজন্য সাক্ষাত, কল্পনায় ইন্ধন জোগাবে বৈকি।


সৌরভ গাঙ্গুলির ওপর বাঙালির এই আশা ভরসার কারণ কী?

রাজনীতিতে সৌরভের আসা নিয়ে এই আবেগ অন্য কোনও বার্তা দিচ্ছে নাতো? একটা ব্যাপারতো পরিষ্কার, সৌরভকে বাংলার রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়া হলে, তাঁর জায়গাটা হবে শীর্ষেই। কোনও বিধায়ক, সাংসদ পদে তিনি আটকে থাকবেন না। অথবা খেলার মাঠের মানুষ বলে তাঁকে ক্রিড়ামন্ত্রক দিয়েও দল তাঁর দায়িত্ব সারবে না। বরং রাজনীতির মানুষ না হয়েও তিনি সম্ভবত টপকে যাবেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের। 


এব্যাপারে তাঁর একমাত্র পূঁজি নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত প্রতিভা। যেই নেতৃত্বের জোরেই ইংল্যান্ডের ৩২৫ রানের ইনিংসকে ধাওয়া করে ম্যাচ বের করে এনেছিল সৌরভ। ২০০২ সালের ১৩ জুলাই। লর্ডসের মাঠে ভারত ছিনিয়ে নিয়েছিল ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি। তারপরেই সেই জবরদস্ত সেলিব্রেশন। কেই বা ভুলেছে সেই দৃশ্যের কথা? লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটানে খুলে ফেললেন গায়ের জার্সি। সেই জার্সি উড়িয়ে টিম ইন্ডিয়ার জয় ঘোষনা করলেন ক্যাপ্টেন। বেশ একটা উগ্র জাতীয়তাবাদী ব্যাপার। শুধু বাঙালীই বা কেন বলি, গোটা দেশ সেদিন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখেছিল এক অন্য সৌরভকে। সবাইকে নিয়ে চলার এই প্রবণতাই সৌরভকে আলাদা করে চেনায়। 


কিন্তু সেই ছবিটাই একদিন বিগড়ে গেছিলো। 

গ্রেগ চ্যাপেল ভারতীয় কোচ হয়ে আসার পরেই। আর সেই পর্বে সবার নজর কেড়েছিল এক সংযমী, জেদি, কুশলী টিম ইন্ডিয়ার তৎকালীন অধিনায়ককে। যিনি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েও এতটুকু ঘাবড়ান না। ২০০৫ সালে চ্যাপেল কোচ হওয়ার পরেই দ্বন্দ্ব শুরু। চ্যালেঞ্জার সিরিজ মিস করায় ক্যাপ্টেনের পদ খোয়ালেন সৌরভ। এমনকি ছেঁটে দেওয়া হলো দল থেকেও। প্রকাশ্যে কোনও ক্ষোভ দেখালেন না। দাঁতে দাঁত চেপে পাস করলেন ফিটনেসের পরীক্ষা। ফের দলে নিজের জায়গাটি ছিনিয়ে নিলেন। ঠিক এই সংযম কিন্তু রাজনীতির দুনিয়ায় প্রায় অচল। অনেক পরে বিস্ফোরক হয়েছিলেন সৌরভ, 'ইলেভেন গডস অ্যান্ড আ বিলিয়ন ইন্ডিয়ান' বইয়ের পাতায়।



চ্যালেঞ্জ নেওয়ার এই ক্ষমতাই সৌরভের হাতে তুলে দিয়েছিল দাদাগিরির ছাড়পত্র। একের পর আর এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস দেখিয়েছেন দেশের ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের প্রশাসকের কুর্সিতে বসে। প্রশাসন চালানোর কাজে দক্ষতার হাজারো নজির রেখেছেন তিনি। একটুও মাথা গরম না করেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কুশলী। রাজনীতিতে এই গুণগুলিই কাম্য।


সৌরভের সহজাত নেতৃত্ব, প্রশাসনে কৌশলী দক্ষতার ওপরে ভরসা রেখেই কি বাঙালি তাকিয়ে সৌরভের দিকে? অনেকেই অবশ্য বলেন, ক্রিকেট আর রাজনীতির ময়দানে বিস্তর ফারাক। যথার্থই তাই। কিন্তু তাহলে বলিউড টলিউড আর দেশের পার্লিয়ামেন্ট কি এক? সেই কবে থেকেই তো ভারতীয় রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন নায়ক নায়িকারা, বিশেষ করে দক্ষিণী রাজনীতিতে। আবার অনেকে শুধুই শোভাবর্ধন করে যান।



তাহলে ক্রিকেট পিচের দাদা রাজনীতির ময়দানে অনেককে বোল্ড করতে পারবেন না কেন? সৌরভ যে পারবেন, তার ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়ে ফেলেছেন রাজনীতির বেশকিছু বাস্তুঘুঘু। সৌরভকে নিয়ে সাংবাদিকরা কিছু প্রশ্ন করলেই, উত্তরের ঝাঁঝ আর লুকানো থাকছে না। তবে এব্যাপারে সম্ভবত সেরা ভবিষ্যদ্বাণীটি করেছিলেন সৌরভ ঘরনী ডোনা। "ও যা করবে তাতেই টপ করবে।" ওই কথাতেই কি কোনও ইঙ্গিত দেওয়া ছিলো? 


যতোই জল্পনা কল্পনা চলুক, সৌরভ গাঙ্গুলি রাজনীতিতে আসছেন এমন কোনও পাকা খবর এমুহূর্তেও নেই। আগামীতে তিনি আর কাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করেন, সেদিকে অবশ্যই নজর রেখে চলবে মিডিয়া। এখন দেখার ডোনা গাঙ্গুলীর কথাই সত্যি হয় নাকি। রাজ্যের টপ জায়গাটিতেই দেখা দেন নাকি বাংলার মহারাজ।

মন্তব্যসমূহ