দিন প্রতিদিন বিশেষ
আমার হারিয়ে যাওয়া শীত
মোনালিসা মুখোপাধ্যায়:
বদলে গেছে শীত। সেই শীত ছিলো আটপৌরে। তবে তার গায়ে ছিল ভীষন শক্তি। একেবারে কাবু করে ফেলতো। আর আমাদের ছিলো মনমাতানো গন্ধের কমলালেবু। ইয়া বড় গাঁদাফুল। আর ব্যাডমিন্টন। গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল- টয়েল না, খড়িফোটা পায়ে খাঁটি সরষের তেল। তেলের বাটি হাতে রোদে বসা। বুড়ো থেকে বাচ্চা। কথাতেই ছিলো, জলে তেলে বাঙালি।
শীত এখন আধুনিক। কমলালেবু সারাবছর। বডিওয়েলের রমরমাতে মুখ লুকিয়েছে সরষের তেলের শিশি। জাতে উঠতে গেলে অলিভ অয়েল বা দামী বডি অয়েল লাগবেই। ।
ছোটবেলায় শীতের দিনে রোদ উঠতে দেখে ঠান্ডায় জমে যাওয়া শালিমার নারকেল তেলের সবুজ টিন সেটা দু'দিকেই ফুটো থাকত সেটা রোদে দেওয়া হত। আমাদের পাশের বাড়িতে জেঠিমা কাঁচের শিশিতে টাটা নারকেলের তেল রোদে দিত। সেটাও জমে যেত। দাদু নাকে কানে নাভিতে সরষের তেল দিত রোদে বসে। তারপর চান। শীতকালে সাবান মানেই তখন চেসমী গ্লিসারিন। ফেনা হত না হাত থেকে পিছলে যেত। একদিকে তুবড়ে যেত। এই সাবানটাতে কেমন শীত শীত গন্ধ ছিল। সাথে তুহিনা বসন্তমালতী সোনায় সোহাগা।
রেফ্রিজারেটর তখন দুর্লভ। তারপর আবার আমিষ নিরামিষের জাতবিচারও ছিলো। শীতকাল মানেই গুড়ের মেলা। গুড়ের নাগড়ী বসানো থাকত রান্নাঘরে। কতরকমের শাকসবজি। বড় বেতের ঝুড়িতে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আলু কড়াইশুঁটি সিম বেগুন মুলো। তবে সবজির পরিবারে অন্ত্যজ ছিলো পিঁয়াজকলি আর পিঁয়াজ। তাদের আলাদা ঝুড়ি রাখা থাকতো রান্নাঘরের বাইরে এককোনায়। আঁশ নিরামিষের লড়াই তখন তুঙ্গে। আঁশবঁটি ছিল তাদের জন্য। ভুলেও মুরগীর মাংস ঢুকত না বাড়িতে। পোলট্রি কী জানতাম না। ডিম মানে হাঁসের ডিম।
আর ছিলো বারো মাসে তেরো পার্বণ। কত মেনে চলত মা জেঠিমা কাকিমারা। ইতু পুজো অগ্রহায়ণ মাসে। ইতুর সরা ভাসাতে হইহই করে গঙ্গায় যাওয়া কাকিমা জেঠিমাদের সাথে। পৌষ মাসে সারাবছরের ধান পাল্টে লক্ষ্মীপুজো। পৌষকালি পুজো দিতে যাওয়া নিস্তারিণী কালিবাড়ি। ওখানে লাল নীল ফিতে মাটির হাড়িকুঁড়ি শীলনোড়া খেলনাবাটির সরঞ্জাম কিনে হইহট্টগোল ভাইবোনেরা মিলে। এত পার্ক ছিল না ঘোরার জন্য। রিসর্টের নামও শোনা যেত না।
তবে শীত এলেই ছিলো ঘোরাঘুরি। মা বাবার হাত ধরে চিড়িয়াখানা ভিক্টোরিয়া যাদুঘর নেহেরু মিউজিয়াম। তারপর অনাদির মোগলাই বা চাচার কেবিনে পেটপূজা। এটাই ছিল আমার শীত। পাড়ায় ফিস্ট হত সবার বাড়ি থেকে চাল আর ডিম নিয়ে। ডিমের ঝোল ভাত। যাত্রার আসর বসতো বান্ধবমাঠে বি এস পার্কে।
তবে শীত এলেই সবার চোখ থাকতো রাশিয়ান সার্কাসের দিকে। তাঁবু পড়ত মাঠে। সকালে আমরা তাঁবুর আসেপাশে ঘুরতাম হাতি দেখব বলে। যাত্রা হতো নট্ট কোম্পানির চেঙ্গিস খাঁ। পারমিশন মিলত না যাত্রা দেখার। অনেক কেঁদে কেটে একবার গেছিলাম। মাটিতে ত্রিপলে বসে বাদাম ভাজা সবুজ নুন দিয়ে খেতে খেতে কী দেখেছিলাম মনে নেই। তবে খুব আনন্দ হয়েছিল সেটা ভুলিনি।
আর ছিলো পুতুলনাচ। বেহুলা লক্ষ্মীন্দর সাবিত্রী সত্যবান। কেঁদে কেঁদে পুতুলনাচ দেখত রেনুপিসি। বেহুলা যত কাঁদে রেনুপিসি তত চোখ মোছে। সে এক অভিজ্ঞতা মজার।
সেই রেনু পিসি বাড়ির উঠোনে কাঁথা সেলাই করতে বসতো। প্রতি শীতে কতরকম কাঁথা সবাই বুনতে দিত। আমরা পাশে বসে দেখতাম। লেপ কাঁথার আর চল নেই তেমন। তার জায়গা নিয়েছে সুন্দর প্যাকেটে ব্ল্যাংকেট। শীতে লেপ কাঁথা রোদে দেওয়া আর এক কাজ ছিল।কালো কুটকুটে কম্বল ছিল অনেকের বাড়ি। লাল সাদা হলুদ ডোরাকাটা শতরঞ্জি পেতে লুডো খেলতাম। আর কে কোথায় চুরি করে ঘুঁটি এগিয়ে দিলো, তা নিয়ে চুলোচুলি।
রেনুপিসির হাতেবোনা খেঁজুর পাতার চাটাই। আমরা শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে দেখতাম। অবিবাহিতা পিসি আপন পর সব ভাইপো ভাইঝিদের খুব প্রিয় ছিল। তার একটা পোষা টিয়া ছিল। আর ছিল এক ঝুমরি নামের গরু। দুধ দিয়ে যেত পিসি। ওই দুধে অনেকটা খেজুর গুড় দিয়ে একবাটি দিত মা আমায়৷ আজও ভুলিনি তার স্বাদ।
কমলালেবু খেয়ে তার খোসাটা চিপে তার রস চোখে দিয়ে চোখের জল ফেলা। আর বলা, চোখ ভালো থাকবে। এটা খেলা ছিল আমাদের বন্ধুদের। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে হাঁটু ছড়ে গেছে। গাঁদাপাতা হাতে রগড়ে নিয়ে চেপে ধরতাম কাটা জায়গায়। চিড়বিড় করে জ্বলত। ভালো হয়ে যেত। জীবাণু আর স্যাভলনের দাপট অত ছিল না।
তখন ছিল হাতেবোনা সোয়েটারের চল। মায়ের হাতে বোনা সোয়েটার পরার আনন্দই আলাদা। উলকাঁটা ছিল সবার শীতের সঙ্গী। কত রকম কাঁটা, কত রঙের নরম উলের গোলা। রিঠে জলে কাচা হত সোয়েটার। তারপর এল জেন্টিল নীল রঙের প্লাস্টিকের বোতলে।
জেন্টিলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলো ইজি।এখন ইজির যুগ। সত্যি খুব ইজি এখন সব। পাল্টে যাওয়া ইজি। সব হাতের মুঠোয় চাইলেই মেলে যদি পকেট সাথ দেয়। শুধু ইজি হলো না ওই ফেলে আসা শীতের গন্ধ মাখা দিনগুলো ভোলা। বারেবারে সেকালে ফেরা আমার, একালে পুরোপুরি মিশে যেতে যেতেও।
মন সেই হারিয়ে যাওয়া শীতে। শরীর আজকের শীতে। মন আর শরীর মেলানোটা আজও ইজি হলো না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন