দিন প্রতিদিন বিশেষ

আজকের বিশেষ , বছরান্তের শেষ ল্যাপ 

বছরের শেষ রবিবারে বাউন্ডারি হাঁকালেন মহারাজ



কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ২৮ ডিসেম্বর 

তোলাবাজি।
বাংলা বাঙালির ঐতিহ্য রক্ষা নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা যখন বাংলা একাডেমির সামনে গলা ফাটাচ্ছেন, ঠিক তখনই তোলাবাজি নিয়ে সরগরম বাংলার রাজনীতি। দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের ভোটবাজার আগে কখনও এরকম সরগরম হয়নি তা নয়। তবে এবার তা যেন বেশকিছুটা মাত্রাছাড়া। আরোপ প্রত্যারোপের ফাঁসে ইতিমধ্যেই সুর চড়িয়েছে বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস।




জোড়াফুল শিবির ছেড়ে পদ্মফুল শিবিরে ঢুকেই মেদিনীপুর থেকে আওয়াজ তোলেন শুভেন্দু অধিকারী- "তোলাবাজ ভাইপো হাটাও।" তারপর থেকে যখনই যেখানে মঞ্চে উঠেছেন, ওই শ্লোগান শোনা গেছে তাঁর মুখে। রবিবার শুভেন্দুর সেই শ্লোগানই বুমেরাং হয়ে ফিরে গেলো তাঁর কাছেই। ডায়মন্ডহারবারের জনসভা থেকে শুভেন্দুকে বিঁধলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, "সারদাতে তোমাকেই টাকা নিতে দেখা গেছিলো। আমি নারদাতেও নেই, সারদাতেও নেই।"




ঘটনায় পরিষ্কার বাংলার রাজনীতিতে ঝড় তুলেছে তোলাবাজি। কোটি- কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে আরোপ প্রত্যারোপ। মাঝেমধ্যেই ঝোলা থেকে বেড়াল বেরনোর মতো বেরিয়ে পড়ে সিবিআই, ইডি। কয়েকদিন হইচই। শোরগোল। টানটান উত্তেজনা। চোরপুলিস খেলা। তারপরেই সব চুপচাপ। বিজেপি বিরোধীরা রসিকতা করে বলেন, ভোট এলেই জুজুর ভয় দেখায় দিল্লির সরকার বাহাদুর। 

দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের ভোটবাজার আগে কখনও এরকম সরগরম হয়নি তা নয়। আরোপ প্রত্যারোপের ওই অভিযোগ পরে ডাহা মিথ্যা বলেও প্রমাণিত হয়েছে। বামপন্থীরা একসময় অপপ্রচারে গাঁধিবাদী প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে স্টিফেন হাউসের মালিক বানিয়ে ছেড়েছিলেন। পরে তা নিছকই অপপ্রচার বলে সাব্যস্ত হয়। এব্যাপারগুলিও কখন যেন বাংলা বাঙালির ঐতিহ্যে ঢুকে পড়েছে।

রবিবার তোলাবাজি নিয়ে দলছুট রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী আর বর্তমান সাংসদের মধ্যে যখন ধুন্দুমার, ঠিক তখনই বাংলা বাঙালির অপমান নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের তীব্র প্রতিবাদ বিজেপির ভূমিকায়। কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের নিয়েও অতীতে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বাম জমানায় অনেক বুদ্ধিজীবীদের আড়ালে আবডালে বলা হতো বুদ্ধজীবী। সেই বুদ্ধজীবীদের অনেকেই পরবর্তীতে রং পাল্টেছেন।


জমি বেদখল নিয়ে ঘটনার শুরু। বিশ্বভারতীর এক মহল থেকে অভিযোগ ওঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জমি স্থানীয় কয়েকজন বিশিষ্টরা দখল করে রেখেছেন। তাঁদের মধ্যেই একজন অমর্ত্য সেন। তাঁর বাড়ি প্রতীচী লাগোয়া কিছু জমি বিশ্বভারতীর। পরম্পরা অনুযায়ী, দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। ওদিকে অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিজেপির মতপার্থক্য অনেকদিন ধরেই বিতর্কে ঘেরা। ওই ঘটনাকে আরও উসকে দেয় বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য। সেই সূত্র ধরেই বিশ্বভারতী, অমর্ত্য সেনের জমিবিবাদে রাজনীতির রং লাগতে দেরি হয়নি।


ঘটনার শুরুতেই বাংলার হয়ে অমর্ত্য সেনের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই ঘটনার সঙ্গে সুর বেঁধেই, ব্রাত্য বসুর নেতৃত্বে বাংলা অ্যাকাডেমির সামনে প্রতিবাদ জানালেন কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা। বিজেপি তৃণমূলের টক্করে কংগ্রেস যেন নির্বাচনী ময়দানে কিছুতেই জায়গা করে নিতে পারছিল না। এই সুযোগটি কাজে লাগাতে নড়েচড়ে বসলেন দলের নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য। বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে অনুরোধ জানালেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমর্ত্য সেনের নাম। তাই ব্যাপারটি বিশেষ বিষয় হিসাবে বিবেচনা করতে। ঠিক এভাবেই অমর্ত্য সেনের নিতান্তই ব্যক্তিগত বিষয়টি রাজনীতির হাতঘুরে চলে এলো জনতার পরিসরে।

ওদিকে অভিষেকের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ তুলে, নিজের জালেই যেন জড়িয়ে পড়লেন শুভেন্দু। গত বছরেই নারদকাণ্ডে সিবিআই তলব করেছিল শুভেন্দু অধিকারীকে। আবার সারদাকাণ্ডে শুভেন্দুর পাশাপাশি জড়িয়ে গেছিলো তাঁর ভাই তৎকালীন কাঁথি পুরসভার চেয়ারম্যান সৌমেন্দু অধিকারীর নামও। অতীতের কথা মনে করিয়ে দিতে অভিষেক বললেন, "সেদিন তোমাকেই টাকা নিতে দেখা গেছিল। সারদা নারদা মামলায় আমার নাম নেই।" তবে সারদা নারদাকাণ্ডে শুভেন্দুর দিকে আঙুল ওঠালে অস্বস্তি বাড়বে তৃণমূল শিবিরেও। কারণ ওই ঘটনায় উঠে এসছিলো ঘাসফুল শিবিরের একাধিক হেভিওয়েটের নাম। তারমধ্যে মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মতো কিছু নেতা পদ্ম শিবিরে নাম লিখিয়েছেন। আর বাদবাকীরা আজও স্বমহিমায় রয়ে গেছেন তৃণমূলে।



একদিকে যখন এমন টানটান উত্তেজনা, ঠিক তখনই অন্যদিকে স্বস্তির বাতাস। বছরের শেষ রবিবারে হাসি ফুটলো শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মুখে। হাসলেন শোভনের বন্ধু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বিজেপিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি সাফ কথায় বললেন, "গত দুবছর অনেক অন্যায় ভোগ করেছি। তার সঙ্গে লড়াই চালানোর জন্য একটা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দরকার ছিলো। সেটা পেলাম।" বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করানোর পর, এবার শোভন বৈশাখীকে ময়দানে নামালো বিজেপি। দলের সাংগঠনিক সুবিধার জন্য গোটা রাজ্যকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এরমধ্যে কলকাতা জোনের পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব সামলাবেন শোভন। সহ আহ্বায়কের পদে থাকছেন বৈশাখী। এছাড়াও দমদম লোকসভার দায়িত্বও থাকছে এই জুটির হাতে।

বছরের শেষ রবিবারের দিনটাই ছিল এপর্যন্ত শহরের শীতলতম দিন। তাপমাত্রার পারদ নেমেছিল ১১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এদিন বিনা নোটিসেই শহরের উষ্ণতা বাড়িয়ে দিলেন মহারাজ। তখন বিকেল সাড়ে চারটা। রাজভবনের গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো একটি গাড়ি, লাল বিএমডবলিউ। সাংবাদিকরা ছুটে যেতেই কাচ নামলো। ভেতরে বসে সৌরভ গাঙ্গুলি। প্রায় আড়াই ঘণ্টা রাজ্যপালের সঙ্গে কথাবার্তা বলে বেরোলেন তিনি। এই প্রথম রাজভবনে যাওয়া, নিজের মুখেই জানালেন সৌরভ। সেই সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত হাসি ছুঁড়ে বললেন, "কিছু স্পেকুলেট করো না।"




মন্তব্যসমূহ