আমেরিকার নির্বাচন বিশেষ
।। বাই বাই ট্রাম্প ।।
"অল রোডস লিড টু হোয়াইট হাউস!" উৎসাহীদের ভিড়ে জমজমাট হোয়াইট হাউসের সামনের চত্বর। সেই ভিড় একসময় চেহারা নিলো জনপ্লাবনের। অচল হয়ে গেলো মোবাইল ফোন। নেটওয়ার্ক জ্যাম। হাজারো মানুষের ভিড় থেকে জয়ধ্বনি বাইডেনের। আর বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে- বাই বাই ট্রাম্প।
ততক্ষণে হোয়াইট হাউসের আকাশে গোল গোল চক্কর মারছে চপার। নিরাপত্তার কড়া ব্যবস্থা। মতগণনার ফল বাইডেনের দিকে ঝুঁকতেই, বাড়ানো হয়েছিল তাঁর নিরাপত্তা। বিশ্বের এক নাম্বার ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিকে কেমন নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকতে হয়, তা হোয়াইট হাউসের সামনে দাঁড়ালেই বোঝা যায়।
আমেরিকার উৎসবের ছোঁয়া লেগেছিল ভারতেও। জন্মসূত্রে আমেরিকার নবনির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের গ্রাম তামিলনাড়ুর থুলাসেন্দ্রাপুরম। গ্রামের ঘরে ঘরে মানুষ অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন। কখন আসে সেই সুখবর! হ্যারিসের জয়ের খবরে সীলমোহর পড়তেই, সবাই বেরিয়ে পড়লেন রাস্তায়। প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিলো। গ্রামজুড়ে দেখা গেলো আগাম দেওয়ালির ছবি। গোটা গ্রামের রাস্তায়, বাড়ির দেওয়াল সেজেছিল আলপনায়। বাজির আওয়াজে, আলোয় আগাম দেওয়ালি। পোস্টারে ছয়লাপ। চললো মিষ্টিমুখ করানো।
শেষ আশা ছিল পেনসিলভেনিয়া। সেখানেও শেষ পেরেক ঠোকা হয়ে গেল রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউস ফেরার রাস্তায়। তাকিয়ে ছিলেন জর্জিয়ার দিকে। সেখানেও আশায় জল ঢালা হয়ে গেল। বাস্তবে তারপর আর কিছুই করার ছিলো না ট্রাম্পের। সেখানকার ২০টি ইলেক্টোরাল ভোট ছিনিয়ে নিলেন ডেমোক্রাটিক জো বাইডেন। সব হিসাব কিতাব মিলিয়ে বাইডেনের সঞ্চয় দাঁড়ায় ২৯০ ইলেক্টোরাল ভোট। ওদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প আটকে গেলেন ২১৪তেই। অগত্যা, যা হওয়ার ছিলো তাই হলো। ভোটগণনার তিনদিন টানা উত্তেজনার পর শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের ছাড়পত্র পকেটে গুঁজলেন জো বাইডেন।
"আপনি আমাকে ভোট দিন বা না দিন, আমি প্রত্যেক আমেরিকাবাসীর প্রেসিডেন্ট।" টুইটবার্তায় দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানালেন বাইডেন।
ওদিকে কমলা হ্যারিস বার্তা দিলেন- এই নির্বাচন জো বাইডেন বা আমার চেয়েও অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। এরসঙ্গেই জড়িয়ে ছিলো আমেরিকার আত্মা। এরজন্যই আমাদের লড়াই। বহু কাজ পড়ে আছে সামনে। এখনই নেমে পড়তে হবে।
প্রতিটি আমেরিকাবাসীর কাছেই এই নির্বাচন যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো, তা বোঝা গেল মতদানের সংখ্যা দেখেই। ভোট পড়েছে ৬৭ শতাংশ। এক শতাব্দীর মধ্যে আমেরিকার এতো মানুষ, এর আগে ভোট দেননি। বলছে সে দেশের খবরের কাগজগুলি। এবারের ভোটে মতদান করেন মোট ১৬০ মিলিয়ন আমেরিকাবাসী।
ইলেক্টোরাল ভোটে ট্রাম্প, বাইডেনের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়লেও, ভোটের ফারাক কিন্তু তেমন আহামরি না। বাইডেন পেয়েছেন ৫০.৬ শতাংশ ভোট। ট্রাম্প পেয়েছেন ৪৭.৭ শতাংশ ভোট।
প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে যে বাইডেন বসছেন, তা মোটামুটি নিশ্চিতই ছিলো। তবু ভোটের প্রক্রিয়া, ভোটগণনা নিয়ে বারেবারে প্রশ্ন তোলেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর সেই ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল সমর্থকদের মধ্যেও। বেশকিছু জায়গায় রাস্তায় নেমে পড়ে ক্ষোভ দেখান তাঁরা। হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন বাইডেন সমর্থকদের সঙ্গে।
বিরোধীদের যাবতীয় ক্ষোভ শান্ত করতে রবিবার এক টুইটবার্তা দেন বাইডেন। তিনি জানান, "আজ রাতে আপনারা কতটা হতাশ, তা বুঝি।" এরপরের অংশেই আবেদনের সুর। "একে অন্যকে একটা সুযোগ দিই। গরম বক্তৃতা দূরে সরিয়ে তাপ কমাই। একে অন্যকে দেখি, একে অন্যকে আবার শুনি।" পাশাপাশি ইঙ্গিত করেছেন কড়া বিরোধিতা বন্ধ করার দিকেও। "আমেরিকায় কাউকে দৈত্য সাজানোর পালা শেষ করার সূচনা হোক- এখন এখানেই।"
ভিকট্রি স্পিচে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছেন- আসুন, ক্ষত সারিয়ে আমেরিকার আত্মা তাকে ফিরিয়ে দিই। এরকম এক প্রেসিডেন্ট হওয়ার অঙ্গীকার করতে চাই যে বিভাজনে না একতায় ভরসা রাখে।
রবিবার আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা টুইটে শুভেচ্ছা জানান বাইডেন, হ্যারিসকে। আমেরিকার ছেচল্লিশতম প্রেসিডেন্ট হলেন জো বাইডেন। অন্যদিকে এই প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট কুর্সিতে অভিষেক হলো এক মহিলার। তাও আবার এক কৃষ্ণাঙ্গ, দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান মহিলার। ভিকট্রি স্পিচে হ্যারিস বললেন, "গণতন্ত্র শুধু এক প্রথা না, প্রক্রিয়াও না।" মৃত মাকে স্মরন করে তিনি বলেন, "এই পদে আমি প্রথম মহিলা হতে পারি, কিন্তু শেষ মহিলা নয়।"
এতো কিছুর পরেও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিন্তু আজও অনড়। আগের মতোই জেদী, একরোখা। বলেছেন, "ভোট শেষ হওয়ার এখনও অনেক বাকী।" ভোটগণনা নিয়ে এখনও তিনি সন্তষ্ট না। বারেবারেই তিনি ভোটে কারচুপির কথা বলা চলেছেন। তবে মার্কিনি আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, ট্রাম্প অভিযোগ করলেও স্বপক্ষ সমর্থনে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দিতে পারছেন না। তবে ঘটনার জল যে দিকেই গড়াক না কেন, ভোটের ফলাফল ঘোরানো সম্ভব হবে না।
ভুলভাল কথা বলার জন্য খ্যাতি আছে জো বাইডেনেরও। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মত, যে কারণগুলি বাইডেনের উচ্চাশাপূরণে বাধা ছিলো, তারমধ্যে প্রধান ছিলো তাঁর ভুল রাজনৈতিক বক্তব্য। প্রশ্ন উঠতে পারে, এবার তাহলে কী হলো? আমেরিকার রসিকজনের মন্তব্য, ভুলভাল কথাবার্তায় ট্রাম্পের কাছে দাঁড়ায় কে? তবে বাস্তবে ডেমোক্রাটিক পার্টি যথেষ্ট সচেতন ছিলো তার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর দুর্বলতা নিয়ে। তাই খুব কম জায়গাতেই মুখ খুলতে দেখা গেছিলো বাইডেনকে। সেখানে ট্রাম্পকে দেখা গেছিল অনর্গল বলে যেতে। তাছাড়া বাইডেনের কাছে আর এক জায়গাতেও পিছিয়ে পড়েছিলেন ট্রাম্প। নির্বাচনী প্রচারের আয়োজন, খরচ খরচায়।
বাইডেন জমানায় ঠিক কোন পথে হাঁটবে আমেরিকা? এব্যাপারে ভারতের রাজনৈতিক মহলেও নানা গুঞ্জন ছড়াচ্ছে। তবে ডেমোক্রাট পার্টির নির্বাচনী প্রচারে যে প্রতিশ্রুতিগুলি দেওয়া হয়েছিল, তার প্রথমদিকেই ছিলো বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক দেশগুলিকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসার কথা। গ্লোবাল সামিট ফর ডেমোক্রাসি। বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশে সেতুবন্ধন।
নির্বাচন শেষ। তবে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছু দিন। আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী নতুন প্রেসিডেন্টের অভিষেক হয় এক নির্দিষ্ট দিনে। সেই দিনটি হলো ২০ জানুয়ারির দুপুরবেলা। সেই নিয়ম মেনেই আগামী বছর জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখ, রাজধানী শহর ওয়াশিংটন ডিসিতে আয়োজন হবে এক রাজসূয় যজ্ঞের। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস শপথ পাঠ করাবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টকে। তারপরেই কমলা হ্যারিসকে সঙ্গে নিয়ে অফিসের দায়িত্ব বুঝে নেবেন জো বাইডেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন