দিন প্রতিদিন বিশেষ

 

বাংলারর পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী ? 


 ।। মুখ দেখিয়ে বাংলাকে মনের আয়না দেখাতে হবে বিজেপির ।।





কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা,  ২৪ নভেম্বর


আপনার মুখই আপনার পরিচয়।
সাল ২০১৯। নির্বাচনটা ছিলো লোকসভার। দিল্লিতে বাংলার প্রতিনিধি পাঠানোর। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুখ সামনে রেখেই ভোটযুদ্ধে নেমেছিল বিজেপি। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। কিন্তু ২০২১ এর নির্বাচন বাংলা বাঙালির। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার। বলা বাহূল্য, এই ভোটে প্রধানমন্ত্রীর মুখ অপ্রাসঙ্গিক। দরকার বাংলার এক পরিচিত মুখ। যার পুরোমাত্রায় সর্বজনগ্রাহ্যতা আছে। ঠিক এমুহূর্তে দলের আস্তিনের নীচে সেরকম কোনও মুখ লোকানো আছে কিনা বলা মুশকিল। আবার এও হতে পারে, তা ক্রমশ প্রকাশ্য। সেই মুখের স্বরূপ কী? আপাতত তা নিয়েই চলছে নানারকম জল্পনা কল্পনা। 

বাংলায় বিজেপির উত্থানের গোড়ার দিকে সবার নজর কেড়েছিলেন রূপা গাঙ্গুলি। তবে পরবর্তীতে তাঁর পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছিলেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলনেত্রীর মোকাবিলা করতে এক মহিলাকে সামনে রেখেই বাংলা জয়ের অভিযানে এগোবে পদ্ম শিবির। রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহলের ধারনাটা ছিলো এরকমই।
কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই ছবিটা বদলে গেলো। রাজ্য বিজেপি খানিকটা ঘর গোছানোর পরেই বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে উঠে এসছিলো অন্য আর এক নাম- বাংলার মহারাজ, সৌরভ গাঙ্গুলি। তার পাশাপাশি আবার শোনা গেছিল এক সন্ন্যাসীর নাম। রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর মোদির দুর্বলতা নিয়েই সম্ভবত ওই কথা ছড়িয়েছিলো। তাছাড়া উত্তরপ্রদেশেও বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেছিল যোগী আদিত্যনাথকে। দুয়ে দুয়ে চার করার হিসেবেই সম্ভবত উঠে এসছিলো বাংলার এক সন্ন্যাসীর নাম। 




তবে এব্যপারে গেরুয়া শিবির সরাসরি মুখ না খোলায়, ঘটনা তখনকার মতো চাপা পড়ে যায়। কিছু উৎসাহী আবার বাংলায় দলের সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়র মধ্যেও বাংলার ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন। তবে সর্বশেষ খবরে যাঁর নাম হাওয়ায় ভাসে তিনি হলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী। অবশ্য সেই বিতর্কে জল ঢেলে অজয়বাবু জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর একটাই পার্টি। আর সেই পার্টি হলো মিউজিক পার্টি।



তবে এরই মধ্যে ঘটে গেছিলো আর এক ঘটনা। কথায় আছে, বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। আর সেই ইশারাটাই অমিত শাহ দিয়ে গেছিলেন গত পয়লা মার্চ কলকাতায় দলের মিছিলে। "আর যেই মুখ্যমন্ত্রী হোক না কেন, সে উত্তরাধিকারী সূত্রে ওই কুর্সিতে বসবেন না।" তিনি সরাসরি কারুর নাম না করলেও, ইঙ্গিত যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই সঙ্গে দলের 'বহিরাগত'র অপবাদ ঘোচাতে অমিত শাহ আরও একটি কাজ করেছিলেন। দিল্লি ফেরার আগে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়ে গেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য বিজেপির পছন্দ বাংলার ভূমিপুত্র। 

শুধু বিজেপিতেই নয়, এমন উৎসাহীরা আছেন কংগ্রেসেও। তাঁরা সামনে নিয়ে এসছেন অধীর চৌধুরীর নাম। কিন্তু কংগ্রেসের মুশকিল হলো, তারা একক ক্ষমতায় ভোট লড়ছে না। এপর্যন্ত পাওয়া খবরে, এবার কংগ্রেসের জোটসঙ্গী হতে চলেছে বামফ্রন্ট। বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএমের ওপরওয়ালারা জোট বাঁধার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে বলে খবর। জোট ভারী করতে ইতিমধ্যেই আহ্বান জানানো হয়েছে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ অন্যান্য দলকেও। 

ওদিকে কংগ্রেসের অতি উৎসাহীরা অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে জোটের মুখ করার কথা তুলতেই বেঁকে বসেছেন রাজ্য বামফ্রন্ট কর্তারা। গোটা ব্যাপারটাই অবশ্য এখনও হাওয়ায় বসছে। তবে দলের দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেনির নেতাদের দাবি, দলের তৃণমূল স্তরের কর্মী সমর্থকরাই অধীরবাবুকে জোটের মুখ হিসেবে চাইছেন। এব্যাপারে খোদ অধীর রঞ্জন বা আবদুল মান্নানের মতো হেভিওয়েটরা এখনও একটি কথাও বলেননি। তবে ঘটনা নিয়ে মুখ খুলেছে সিপিএম। কংগ্রেসের অতি উৎসাহীদের দাবি খারিজ করতে তাঁরা একটুও দেরি করেননি। বামফ্রন্টের সাফ কথা, জোটে দুই দলেরই একাধিক শীর্ষ নেতারা আছেন। তাই নির্দিষ্ট একটি মুখকে সামনে রেখে ভোটযুদ্ধে নামার পক্ষে সিপিএম মত দেবে না। 

ব্যতিক্রম একমাত্র তৃণমূল কংগ্রেস। রাজ্যের শাসনে থাকার সুবাদে তার ঘর গোছানোই আছে। তবে ওই শাসনে থাকার পরিণামে ঘরের ভেতরে বাইরে বিরোধও আছে। কিন্তু ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর মুখ নিয়ে কোথাও কোনও সংশয় নেই। সবাই জানেন, তৃণমূল কংগ্রেসের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন মানেই ক্ষমতার রাজদন্ড তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। ওদিকে বাংলার বুকে আন্দোলনের অভিজ্ঞতাতেও বিজেপি পাত্তা পায় না তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। বাংলা বাঙালির কাছে জোড়া ফুল শিবিরের মুখ নিয়ে বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা নেই। 

তৃণমূলের জোড়া ফুলের মতোই জোড়া মুখ দেখিয়ে বিহার জয় করেছিলো বিজেপি। বিহারে এনডিএ'র নির্বাচনী ইস্তাহারেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর নাম নীতিশ কুমার। আবার নির্বাচনী প্রচারের মুখ বলতে ছিলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। আর আমরা দেখেছিলাম সেই 'মোদি- কুমার'- এর জোড়া মুখের কামাল।






বাংলায় বিজেপির মুখ বলতে এমুহূর্তে দিলীপ ঘোষ। সেই মুখ অনেকের কাছেই যে গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণ হয়েছিল গত লোকসভা নির্বাচনেই। তবে দিলীপবাবুর মুখকে সামনে রেখে বিধানসভা নির্বাচনের লড়াইয়ে নামার কথা খোদ বিজেপিও ভাবে না। এক জবরদস্ত মুখ সামনে না রেখে লড়াইয়ে নামার ফল যে ভালো হয় না, তা দিল্লিতেই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলো গৈরিক বাহিনী। মুখ্যমন্ত্রীর আসন ছিনিয়ে নিয়েছিলেন 'আপ'- এর পূর্বনির্দিষ্ট প্রার্থী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। 

আবার এর উল্টোটাও যে হয়নি, তা নয়। উত্তরপ্রদেশে কোনও মুখ ছাড়াই ভোটযুদ্ধে নেমেছিল পদ্ম শিবির। তবে সেখানে কাজ করেছিল অন্য এক সমীকরণ। দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদিকে দিল্লি পাঠিয়েছিল রাজ্যের বারাণসী লোকসভা কেন্দ্র। তাই রাজ্য রাজনীতি ছাপিয়ে উত্তরপ্রদেশবাসীর কাছে দিল্লির বিশ্বস্ততা অনেক বেশি গ্রহণীয় মনে হয়ে ছিলো। পশ্চিমবঙ্গের কাছে কিন্তু দিল্লির সেই বিশ্বস্ততা নেই। বরং উল্টোটাই। বাংলায় দিল্লি বিরোধিতার এক ধারাবাহিকতা তৈরি করেছে রাজ্যের শাসকদল। নাগাড়ে ৩৪ বছর বাম জমানা যে দিল্লি বিরোধিতার রাস্তা দেখিয়েছিল, তৃণমূল কংগ্রেসও শেষ পর্যন্ত সেই রাস্তাতেই হাঁটে। 

ওদিকে বিজেপি বিহার নির্বাচনের পর বাংলা দখলে আক্রমণ শানাতেই, কড়া প্রতিরোধ তৈরি করে মূল প্রতিপক্ষ তৃণমূল কংগ্রেস। বহিরাগতর তকমা এঁটে পদ্ম শিবিরকে দূরে সরিয়ে রাখার রণকৌশল নেওয়া হয়। ঘটনার মধ্যে যে সারবত্ত্বা নেই তাও নয়। কারণ আজ পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য রাজ্যস্তরে বিজেপির কাছে এমন একটিও মুখ নেই, যাঁকে দেখে বাংলা আশ্বস্ত হবে। বিজেপির 'রাম রাজনীতি'ও বাস্তবে বাংলায় অচল। জয় শ্রীরাম শ্লোগানে বিহার উত্তরপ্রদেশকে যেভাবে নাচানো যায়, বাংলায় তা অসম্ভব এক কল্পনামাত্র। গো বলয়ের ওই সংস্কৃতিই বিজেপিকে 'বহিরাগত' প্রমাণের জন্য যথেষ্ট সাব্যস্ত হতে পারে। 

কথায় আছে, মুখ যে মনের আয়না।
বিজেপির মনে কী আছে তা আজও অজানা বাংলার কাছে। মুখ দেখিয়েই আপাতত তা প্রমাণের দায় দিলীপ ঘোষ, অমিত শাহ, কৈলাস বিজয়বর্গী, জগত প্রকাশ নড্ডার। তাহলে কি শেষ মুহূর্তের জন্য কোনও চমক অপেক্ষা করছে? যে মুখ দেখে বাংলা বাঙালি চমকে উঠবে।


মন্তব্যসমূহ