রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  


আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   

ঝুলবারান্দার নীচে #৩৭


সন্দীপ চক্রবর্তী
কাল ছবির কাছ থেকে চলে আসার পর সারাদিন কোথাও বেরোইনি। কোথাও আটকে থাকা আমার পছন্দ নয়। তবুও কাল নিজের ঘরটিতে আটকেই ছিলাম। ভাবছিলাম ছবির কথা। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর রজত এলো। ওকে বললাম সকালের সব কথা।
রজত রাজকীয় ভঙ্গীতে সিগারেট ধরিয়ে বলল, আমি জানতাম তুই পারবি। ইউ হ্যাভ দা পাওয়ার টু ব্রেক দা ইলিউশন অ্যান্ড ব্রিং হার ইনটু রিয়ালিটি। ব্রিলিয়ান্ট! আয়াম রিয়েলি প্রাউড অব ইউ।
বন্ধুর টেনশন কমাতে পেরেছি দেখে ভালো লাগল। বললাম, তবে আমি কিন্তু কাল তোদের সঙ্গে কৃষ্ণনগর যাচ্ছি না৷
যাচ্ছিস না মানে? তোর তো পুরো ট্যুরটায় আমাদের সঙ্গে থাকার কথা!
কথা ছিল। কিন্তু আর থাকছে না। ছবির এখন স্পেস দরকার। আমি কাছে থাকলে ও সেই স্পেস পাবে না। আর তাতে ওর ইলিউশন ফিরে আসতে পারে। অনেক দিন আগে সাধন বোষ্টুমির গলায় একটা গান শুনেছিলাম। আয়না আমায় যে মুখ দেখায়/ আমি তো সে নই/ মনমুকুরে হাসে কাঁদে/ সে মুখ আমার কই। ছবিকে ওর আসল মুখটা খুঁজে নিতে দে রজত।
কলকাতায় ফিরে যাবি?
না। নবদ্বীপে যাব। নিতাই ঠাকুরের আশ্রমে। ওখানে দু'দিন থেকে তারপর কলকাতা।
ছবি এসব জানে?
এখনও পর্যন্ত জানে না। তবে ওকে আমিই জানাব।
সন্ধ্যেবেলায় গিয়েছিলাম ছবির ঘরে। তখনও ও সকালের আঘাতে দিশেহারা। মদ্যপানে বিরাম নেই। চোখেমুখে একটা আলুথালু ভাব। পোশাকের ছিরিছাঁদ নেই। অবিন্যস্ত চুল। কে বলবে এই মেয়েটা যাত্রাজগতের ভাবী সুপারস্টার! চাঁদে গ্রহণ লাগে জানি, নক্ষত্রেও কি লাগে? মুহূর্তের জন্য নিজেকে অপরাধী বলে মনে হল। ওর ভালো লাগে এমন কোনও কাজ কি আমি করতে পারি না? এই তীব্র টানাপোড়েন হয়তো আমাকে সব ভুলিয়ে দিত। মনেই করতে পারতাম না কেন এসেছি ছবির কাছে। কিংবা পারলেও মনে রাখতে চাইতাম না। ভাগ্যিস দুলারির একটা কথা মনে পড়ে গেল। আমি তাই আবার সহজ হতে পারলাম। অনেকদিন আগে দুলারি একবার বলেছিল, সাচ কে দো হাত হতে হ্যায় বাবুজী। এক হাত দিল তোড়তা হ্যায়। দুসরা হাত টুটা দিল কো জোড়তা হ্যায়৷--কথাটা আমাকে আশ্চর্য এক শক্তি দিল। ছবির পাশে বসে বললাম, এই তো সকালে বললে দেবদাস হবার জন্য তুমি জন্মাওনি। তা হলে এখন দেবদাস হয়ে আছ কেন?
ছবি হাসল, কে বলল দেবদাস হয়েছি! আসলে কিছু ভালো লাগছে না। তাই ঘর থেকে বেরোইনি।
অনেকক্ষণ কথা বললাম ওর সঙ্গে। মিথ্যে সান্ত্বনা আমি কাউকে দিই না। মিথ্যে স্বপ্নও কাউকে দেখাই না। তাই ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটাই জিজ্ঞাসা আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কী বলব ওকে? কৃষ্ণনগরে না যাওয়ার কী কারণ দেখাব? গোড়ায় ভেবেছিলাম অফিসের কোনও জরুরি কাজের কথা বলব। কিন্তু না, তা হয় না। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ তিনি তা হতে দেননি। জীবনের যে কঠিন সত্যের উন্মোচনে ও আজ দিশেহারা সেই সত্য তো আমারই উপহার। তা হলে আমি কীভাবে ওর সঙ্গে মিথ্যাচার করতে পারি? তাই সত্যিটাই বললাম, কাল আমি তোমাদের সঙ্গে কৃষ্ণনগর যাচ্ছি না ছবি। ভেবে দেখলাম এখন আমাদের কিছুদিন দূরে থাকাই ভালো। দূরে থাকাটা যখন আমরা অভ্যেস করে ফেলতে পারব তখন কাছে এলেও কোনও অসুবিধে হবে না।
কিছুক্ষণ কোনও কথা বলল না ছবি। তারপর আমাকে অবাক করে বলল, আমিও তাই ভাবছিলাম সন্দীপদা। তুমি বললে ভালোই হল। আমি তোমাকে বলতে পারতাম না।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সর্বংসহা ধরিত্রীর কথা শুনেছি। কিন্তু মেয়েদের কেন ধরিত্রীর সহোদরা বলে ছবি আমাকে বুঝিয়ে দিল। মানুষ দেখতে বেরিয়েছি। ছবির মধ্যে একজন সত্যিকারের মানুষ দেখলাম।
আজ সকালে ওরা চলে গেল। আর আমিও রওনা দিলাম নিতাই ঠাকুরের আশ্রমের দিকে। আমার ছোট্ট জগতে যেসব জায়গা কখনও পুরনো হয় না, নিতাই ঠাকুরের আশ্রম সেরকম একটি জায়গা। অনেকবার এসেছি। আরও অনেকবার আসতে চাই। আমার সংকল্প শুনে নিতাই ঠাকুর হয়তো বলবেন, আসার দরকার কী মশাই! আপনার যেখানে খুশি থাকুন, যেখানে খুশি যান-- জেনে রাখবেন মহাপ্রভুর আশীর্বাদে আপনার খবর আমি ঠিকই পেয়ে যাব।-- আমিও হয়তো ঠাট্টা করব, মহাপ্রভু বুঝি আপনার কানে কানে আমার কথা বলে যাবেন?-- তিনি বলবেন, মনকে জ্যান্ত করতে পারলে ওসব কান-ফান লাগে না মশাই। মনের দিকে তাকিয়ে যা খুশি জিজ্ঞাসা করুন, জবাব পেয়ে যাবেন।-- মানুষটি তা পারেন। মনকে জ্যান্ত করতে পারেন। শুধু নিজের মনকেই নয়, অন্যের মনকেও জ্যান্ত করে দিতে পারেন। আমার মন তো তিনিই সাজিয়ে দিয়েছিলেন। ছিলাম তো সারাদিন টেবিল-চেয়ারে বসে ঘাড় গুঁজে লিখে যাওয়া বন্ডেড লেবার। মাঝে মাঝে ওর আশ্রমে যেতাম। ঈশ্বরলাভের আশায় নয়, বেড়াতে। একদিন বললেন, এখানে কেন এয়েছেন মরতে! মানুষের সঙ্গ করুন। ওতেই আপনার ঈশ্বরলাভ হবে।
সঙ্গ করার সেই শুরু। তারপর থেকে মানুষের সঙ্গই তো করে চলেছি। কিন্তু জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে যখনই নিজের মুখটি অস্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিতাই ঠাকুরের চোখের আয়নায় নিজেকে দেখব বলে ফিরে আসি এখানে। আজ অবধি এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয়নি।
নিতাই ঠাকুরের কথা ভাবতে ভাবতে ওর আশ্রমে পৌঁছে গেলাম। বছরখানেক আগে শেষ এসেছিলাম। দেখলাম বিশেষ কিছুই বদলায়নি। লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে গেলে দু'দিকে বাগান। বেশিরভাগই ফুলের গাছ। জুঁই, বেল, টগর, গন্ধরাজ, কাঁঠালিচাঁপা, শিউলি। দূরে একটা কেতকী ফুলের গাছ। আশ্রমের মূল মন্দিরটি রাধাগোবিন্দের। এ ছাড়া আছে গোপাল মন্দির আর মহাপ্রভুর মন্দির। রাধাগোবিন্দের মন্দিরের পিছনদিকে গেলে চোখে পড়বে গুটিকয়েক ঘর। অতিথি-অভ্যাগতরা এলে এখানে থাকেন। এ ছাড়া আছে দোলমঞ্চ। দোলের দিন কৃষ্ণ এখানে রাধার সঙ্গে আবির খেলেন। সারাদিন উৎসব হয়।
রাধাগোবিন্দের মন্দিরে প্রণাম করার সময় ধরা পড়ে গেলাম। প্রথম দেখল ভগীরথ। নিতাই ঠাকুরের ডানহাত। চোখেমুখে হেসে বলল, আজ কার মুখ দেখে উঠলাম গো! কে এয়েচে একবার দেখো দেখি সবাই।
কেমন আছিস ভগীরথ?
আজ্ঞে মহাপ্রভুর কিরপায় ভালো আচি। আপনি কেমন আচেন দাদা?
আমি ভালো আছি। তোর ঠাকুর কোথায়?
আজ্ঞে ঠাকুর ঘরে আচেন। কাল রেতেই আপনার কথা কইছিলেন। কইলেন, তার আসার সময় হয়েছে রে ভগীরথ। তোরা সব তৈরি হ। চলেন, ঠাকুরের ঘরে চলেন।
নিতাই ঠাকুর তক্তাপোশে বসে চোখ বন্ধ করে নাম জপ করছিলেন। পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ খুললেন। তারপর আমায় দেখে বললেন, জয় গুরু! মন বলছিল আপনি আসবেন। নবদ্বীপে কবে এলেন?
আগমন-বৃত্তান্ত জানালাম। নিতাই ঠাকুর চোখ কপালে তুলে বললেন, বলেন কী মশাই! একেবারে যাত্রাদলের সঙ্গে? অবশ্য উপন্যাসের মালমশলা খুঁজতে হলে নিজের চোখে সব দেখাই ভালো। তা, কিছু পেলেন নাকি খোঁজাই সার?
একে একে মুখগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। জীবন মাস্টার, সদাশিবদা, ছবি। বললাম, না ঠাকুর। পেয়েছি। অনেককিছু পেয়েছি।
নিতাই ঠাকুর চোখ মেলে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। ওর দৃষ্টি বড়ো গভীর। এক-এক সময় মনে হয় যেন গোপন বলে আর আমার কিছু রইল না। সব ওর চোখে ধরা পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নিতাই ঠাকুর আবার স্বাভাবিক। বললেন, পেয়েছেন যখন মনে এত বিষাদ কেন মশাই!
সব পাওয়া কি আনন্দের হয় ঠাকুর?
ঠিক বলেছেন। সব পাওয়া আনন্দের হয় না। তবে এখন ওসব কথা থাক। তেতেপুড়ে এলেন।-- ওরে ভগীরথ হাঁ করে গল্প শুনলে হবে না বাবা। ইনি মশাই মানুষ। ঘন্টায় ঘন্টায় চা চাই৷ মিনিটে মিনিটে সিগারেট চাই। তুই আগে চা-জলখাবারের ব্যবস্থা কর। দুপুরের খাওয়ার এখনও ঢের দেরি।
ভগীরথ চলে গেল।
নিতাই ঠাকুর বললেন, হাতমুখ ধুয়ে এখন একটু বিশ্রাম নিন। দুপুরে কথা হবে।
অতিথিশালার একটি ঘরে থিতু হলাম। কিছুক্ষণ পর ভগীরথ ঝুরো নারকেল দিয়ে মাখা মুড়ি আর চা দিয়ে গেল। আশ্রমে ধুমপান নিষিদ্ধ। কিন্তু আমার জন্য নিয়মটি সামান্য শিথিল করা হয়েছে। নিতাই ঠাকুরের কড়া নির্দেশ, ঘরে বসে যত খুশি সিগারেট খান মশাই, আমি দেখতে আসব না। কিন্তু ঘরের বাইরে খাবেন না।-- এখানে থাকলে আমি ওর নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। আর উনিও আমি যে ঘরে থাকব সেখানে টেবিল-চেয়ার এবং একটি অ্যাশট্রের ব্যবস্থা করে রাখেন।
সিগারেট খেয়ে আশ্রম দেখতে বেরোলাম। একটু পরেই মন্দিরে মন্দিরে অন্নভোগ দেওয়া শুরু হবে। তার আগে গোপাল এবং মহাপ্রভুর দর্শন করে নিতে চাই।
গোপাল মন্দিরের চাতাল এখন ফাঁকা। অন্য সময় হলে এই শূন্য চাতাল আমার ভালো লাগত না। মানুষের সিংহাসন খালি পড়ে থাকলে আমি কষ্ট পাই। কিন্তু আজ এই শূন্যতাই আমার বড়ো কাছের হয়ে উঠল। ঈশ্বরের কাছে একটা প্রশ্নের উত্তর জানার খুব ইচ্ছে হল। জীবনে যা কিছু সত্য বলে মানি তার প্রতি অবিচল থাকার জন্য আমি কষ্ট পাই ক্ষতি নেই কিন্তু আমাকে যারা ভালোবাসে তাদের কেন কষ্ট দিতে হয়?
প্রণাম করে ফেরার সময় চেনা গলায় কেউ ডাকল, নমস্তে বাবুজী!
পিছন ফিরে দুলারিকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম।-- আরে তুম! কব আয়ি?
পরশো। ঠাকুরজী কা আশ্রম মে কয়ি বার আয়ি হুঁ। লেকিন বংগাল কা দুর্গাপূজা কভি নহী দেখা। ইসবার পূজা দেখনে কে লিয়ে আয়ি হুঁ৷
ক্যায়সি হো তুম?
বাস লাল্লাহ মেরে সাথ হ্যায় তো সব ঠিক হ্যায়৷ আপ ক্যায়সে হ্যায় বাবুজী।
ম্যায়-- ম্যায় ভি ঠিক হুঁ৷
সংক্ষিপ্ত কথপোকথন সেরে চলেই আসছিলাম। দুলারি আবার ডাকল, এক বাত পুছুঁ বাবুজী? আপ তো সদা হাসমুখ ইনসান থে। লেকিন আজ আপ কো বহুত দুখী লাগ রাহা হ্যায়।
কিছু বললাম না। বলতে পারলাম না। একটা কষ্ট আমায় চুপ করিয়ে দিল। আমি মুখে কিছু না বললেও দুলারি যে আমার দুঃখের সন্ধান পেয়ে গেল তার কারণও তো ভালোবাসাই। হয়তো ওর ভালোবাসা ছবির মতো নয়। মোহরের মতোও নয়। কিন্তু ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। ঈশ্বরকে মনে মনে বললাম, আমাকে যারা ভালোবাসে তারা আমার জন্য বড়ো দুঃখ পায়। আমার প্রতি দুলারির ভালোবাসার চরিত্র যাই হোক, আমি যেন ওকে কখনও দুঃখ না দিই। তুমি শুধু এইটুকু দেখো।
(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ