দিন প্রতিদিন বিশেষ

 পুলওয়ামা বিশেষ 


।। পুলওয়ামাকাণ্ডে বিরোধীদের সওয়ালের কড়া জবাব মোদির ।।





     কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা, ৩১ অক্টোবর:


পুলওয়ামাকান্ডে কার লাভ?

বারেবারে সওয়াল করেছিলেন রাহুল গাঁধি। প্রমাণ দাবি করেছিলেন বালাকোটে ভারতীয় সেনার প্রত্যাঘাতের। সন্দেহর পর সন্দেহ। রাজা যত বলে পারিষদ- দলে বলে তার শতগুন। রণদীপ সুরজেওয়ালার মতো পারিষদরা সেই শত সহস্রগুন বলে চলেছিলেন। পুলওয়ামা কাণ্ডের তদন্ত রিপোর্ট সরকার চেপে ররেখেছে কেন? কে এনেছিল বিস্ফোরক? 

কম যাননি অরবিন্দ কেজরিওয়ালও। তিনি বলেছিলেন, "ইমরান খানের সঙ্গে যোগসাজশ ছিলো মোদির।" একই সুর শোনা গেছিল জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লার গলাতেও। শনিবার রাষ্ট্রীয় একতা দিবস উপলক্ষ্যে, বিরোধীদের ভুমিকার কড়া সমালোচনা করেন মোদি।


মোদি বিরোধী শিবিরের পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছেন পাকিস্তানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ফয়াদ চৌধরী। তাও বিনা নোটিসে। তিনি পাক সংসদে জানিয়েছেন, পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলা চালানোর দায় ইমরান সরকারের। পাকমন্ত্রীর ওই বক্তব্য জানাজানি হতেই, বিরোধীদের কড়া ভাষায় দুকথা শুনিয়ে দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শুধু তাই না, পুলওয়ামা কাণ্ডে পাক সংসদে ফয়াদের স্বীকারোক্তির পর সামনে চলে এসছে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের অনর্গল মিথ্যা ভাষনের প্রকৃত চেহারাটা। সবচেয়ে মজার কথা, পাক রাজনীতিতে ফয়াদ চৌধুরীর পরিচয় ইমরান ঘনিষ্ঠের।

পুলওয়ামায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গীদের আত্মঘাতী হামলায় প্রাণ গেছিল চল্লিশজন সিআরপিএফ জওয়ানের। আর ঠিক তারপরেই লাভ ক্ষতির পাটিগনিত কষতে বসেছিলেন রাহুল। কোন যুক্তিতে? পুলওয়ামা বিস্ফোরণ হয়েছিল গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। তারপর দুমাস কাটতে না কাটতেই ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছিল লোকসভা নির্বাচন। কথায় বলে, বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট। ওই প্রশ্ন আসলে ছিল সেই ইশারা। আর তারও আড়ালে ছিলো এক জবরদস্ত খোঁচা। নির্বাচনে গোটা ঘটনার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সন্দেহ। 


সরাসরি রাহুল গাঁধির নাম না নিয়ে তাঁর সন্দেহবাতিক নিয়ে প্রথম খোঁচাটা মেরেছিলেন বিজেপি নেতা জগত প্রকাশ নড্ডা। "এবার তাঁর সবচেয়ে আস্থার দেশ পাকিস্তান থেকে কিছু খবর এসছে। আশা করা যায় তিনি আলোর সন্ধান পাবেন। কংগ্রেস আদর্শগত ভাবে ভারতের কোনও কিছুতেই ভরসা করে না। তা সেনা হোক বা সরকার, চাইকি নাগরিক।"

এরপরেই আজ মুখ খোলেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। গুজরাটে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৪৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে 'স্ট্যাচু অফ ইউনিটি'তে শ্রদ্ধাতর্পণ জানাতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, "পাকমন্ত্রীর স্বীকারোক্তির পর যাঁরা পুলওয়ামা শহিদদের নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন, তাঁদের স্বরূপ প্রকাশ হয়ে গেছে। স্পষ্ট হয়েছে হামলাবাজির পেছনে পাকিস্তানের ভুমিকা। গোটা দেশ যখন শোকস্তব্ধ, তখনও কিছু মানুষ ব্যস্ত ছিলেন নোংরা রাজনীতি করতে।" সবশেষে নরেন্দ্র মোদির হুঁশিয়ারি, "মতলববাজ রাজনীতিকদের হাতের পুতুল হবেন না।"


"হমনে ইন্ডিয়া কো ঘুসকে মারা (ভারতকে ঘরে ঢুকে পেঁদিয়ে এসছি)!" এতদিনে ঘটনার দায় স্বীকার করলো ইসলামাবাদ। বৃহস্পতিবার পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে জোর গলায় শাসক দলের বীরত্বের কাহিনি শোনান ইমরান খান মন্ত্রিসভার ফয়াদ চৌধরী।

আসলে বিরোধী দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ(নওয়াজ)- এর নেতা সর্দার আয়াজ সিদ্দিকির তোপের মুখে পড়েছিল শাসক দল। "ভারতের হামলার ভয়ে বৈঠকে পা কাঁপছিল শাসক দলের ওপরতলার নেতাদের। ঘাম ফুটেছিলো কপালে। বিদেশ মন্ত্রী শাহ মহম্মদ কোরেশি অনুরোধ জানান, ভারতের কাছে উইং কমান্ডার অভিনন্দন ওয়ার্ধমানকে ফিরিয়ে দিন। রাত নটা নাগাদ পাকিস্তানের ওপর হামলা চালাতে প্রস্তুত ভারত।" এরপরেই কোরেশি বলেন, "ভারত মোটেই হামলা চালানোর কথা ভাবেনি। চেয়েছিল ভারতের কাছে পাকিস্তানকে ঝুঁকিয়ে অভিনন্দনকে মুক্ত করতে।" 

পাক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিরোধীরা ভারতভীতির অভিযোগ ওঠাতেই, পুলওয়ামা জঙ্গী হামলার রহস্য ফাঁস করে বসেন ফয়াদ। ইমরান খানের বীরত্বের গুণগান করতে গিয়েই তিনি জঙ্গী হামলার নেপথ্যে শাসক দলের মদতের কথা স্বীকার করেন।


এবার কী বলবেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান? 

সিআরপিএফ কনভয়ের ওপর অতর্কিতে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছিল পাক মদতপুষ্ট জঙ্গী সংগঠন জইশ- ই- মহম্মদ। প্রাণ যায় চল্লিশজন জওয়ানের। সন্দেহের আঙুল ওঠে পাকিস্তানের দিকে। ঘটনার পাঁচদিন পর মুখ খোলেন ইমরান। তিনি অভিযোগ করেন, অকারণেই পুলওয়ামা কাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানের নাম। এমনকি ভারতকে হুমকি দিয়ে তিনি বলেন, "ভারত যদি ওই ঘটনার বদলা নিতে পাকিস্তানের ওপর হামলা চালানোর কথা ভেবে থাকে তাহলে ভুল করছে। পাকিস্তানও হামলার জবাব দিয়ে বসে থাকবে না, পাল্টা আক্রমণও চালাবে।" গোটা ঘটনার প্রেক্ষিতে দাবি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের মধ্যস্থতা। পুলওয়ামা বিস্ফোরণের সঙ্গে ইসলামাবাদের কোনও যোগের কথা সরাসরি অস্বীকার করেছিলেন ইমরান।



পুলওয়ামা ঘটনার একবছর পরেও রাহুল প্রশ্ন তোলেন, ওই ঘটনায় কার লাভ হয়েছিল? তদন্ত রিপোর্ট কী বলে? নিরাপত্তায় ফাঁক থাকার জন্য বিজেপি সরকার কাকে দোষী চিহ্নিত করলো? রাহুলকেও টপকে গেছিলেন জম্মু কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। "ভোটে জেতার জন্যই মোদিসাহেব ওই কান্ড ঘটিয়েছিলেন।" গতবছর শ্রীনগরের নির্বাচনী প্রচারে সাংবাদিকদের সামনে কোনও রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছিলেন ফারুক আবদুল্লা। ওদিকে কেজরিওয়ালের বক্তব্য ছিলো, ইমরান খান খোলাখুলি ভাবেই সমর্থন করছেন মোদিকে। এক টুইটারবার্তায় তিনি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান- সবাই জানতে চায়, ভোটের ঠিক আগে পাকিস্তান আমাদের ৪০জন সিআরপিএফ জওয়ানকে হত্যা করে কি মোদিকে সাহায্য করলো?" গোটা ঘটনাই সাজানো বলে মন্তব্য করেছিলেন সমাজবাদী পার্টির রামগোপাল যাদব। পুলওয়ামা বিস্ফোরণের দিনক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।


গুজরাতের ওই অনুষ্ঠানে, বিরোধী শিবিরের যাবতীয় প্রশ্নকে সরাসরি নোংরা রাজনীতি বলে মন্তব্য করেছেন মোদি। তিনি বলেন, "রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনও সীমা পরিসীমা লঙ্ঘন করতে পারেন কিছু মানুষ। সেদিন মতলববাজ, উগ্র রাজনীতি তুঙ্গে উঠেছিল।" এরপরেই তিনি বিরোধী শিবিরকে সতর্ক করেন, এমন কিছু করবেন না যাতে দেশের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে যাঁরা আছেন তাঁদের মনোবলে চিড় ধরে।"


ফয়াদের ওই স্বীকারোক্তি নিশ্চিতভাবেই ইমরান খান সরকারের পাশাপাশি, বিপাকে ফেলে দিয়েছে এনডিএ বিরোধী শিবিরকে। পাকমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে পরিষ্কার পুলওয়ামা কাণ্ডের পর পাকপ্রধানমন্ত্রী যা বলেছিলেন তার গোটাটাই ভিত্তিহীন। ওদিকে এতদিন পুলওয়ামা কান্ড নিয়ে রাহুল গাঁধি, কেজরিওয়াল, ফারুক আবদুল্লার মতো বিরোধী নেতারা ওই ঘটনার সঙ্গে মোদিকে জড়িয়ে যেসব প্রশ্ন তুলতেন, তার গোটাটাই অমূলক। আশা করা যায়, পাকমন্ত্রীর বক্তব্যে মোদি বিরোধীরা যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। 


তাঁর বক্তব্যকে ভারত হাতিয়ার করতেই সম্বিত ফিরেছে ফয়াদ চৌধরীর। ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমেই তিনি কাঠগড়ায় তুলেছেন ভারতের সংবাদমাধ্যমকে। ফয়াদের দাবি, তাঁর বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে। চাপের হাত থেকে বাঁচতে তিনি বলেন, "২৬ ফেব্রুয়ারির পরের ঘটনার কথা বলেছিলাম।" ফয়াদের ডিগবাজি খাওয়া ওই বয়ানেই লুকিয়ে আছে রাহুল গাঁধির আর এক প্রশ্নের উত্তর। পুলওয়ামা জঙ্গী হামলার জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোটে জঙ্গী ঘাঁটি তছনছ করে দেয় ভারতীয় বায়ুসেনা। ওই সময়েই পাক সেনার গুলিতে বিমান ভেঙে পড়ায় বন্দি হন উইং কমান্ডার অভিনন্দন ওয়ার্ধমান। সরকারের কথায় ভরসা না করতে পেরে, বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনা হানার ঘটনার প্রমাণ চেয়েও একাধিকবার সোচ্চার হয়েছিলেন রাহুল গাঁধি। 


ওদিকে পুলওয়ামা বিতর্ক ফের জোড় ধরতেই, সাতেও নেই পাঁচেও নেই- এর অবস্থান সিপিএমের। পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গী সংগঠনের হামলাবাজির ঘটনা নিয়ে মোদি সরকারের বিবৃতি দাবি করেছেন দলের নেতা সীতারাম ইয়েচুরি।

মন্তব্যসমূহ