মুঙ্গের কান্ড বিশেষ
।। মুঙ্গেরকান্ড নিয়ে চাপে নীতিশ ।।
কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা, ৩০ অক্টোবর:
বুধবার বিহারের প্রথম দফা ভোটে মুঙ্গেরবাসী কাকে এগিয়ে রাখলো?
তবে পরিস্থিতি বলছে, সোমবার রাতের ঘটনায় পুলিসের ভুমিকায় বিস্তর ক্ষোভ জমেছিল মানুষের মনে। অবধারিত ভাবেই তার প্রভাব পড়েছিল ইভিএমে। অঙ্কের হিসেব বলছে, প্রথম দফার নির্বাচনে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে মুঙ্গের আর জামালপুরের তিন বিধানসভার দুটিতে।
মুঙ্গেরের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা দেখিয়েছে নির্বাচন কমিশন। কমিশনের নির্দেশে ইতিমধ্যেই সরে যেতে হয়েছে অভিযুক্ত ডিএম, এসপিকে। জেলার দায়িত্ব সামলাতে এসছেন নতুন ডিএম, এসপি।
গত ২৬ অক্টোবর দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের ঘটনায় মুঙ্গেরে যে ক্ষোভের আগুন জ্বলেছিলো, ২৮ তারিখ ভোটের দিনে তার আঁচ পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তার মধ্যেই নির্বাচন হয়েছে নির্বিঘ্নে। তবে ভোট পড়ার হিসেবে স্পষ্ট, মানুষ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলো। আর তারই প্রতিফলন হয়েছিলো ইভিএমের হিসেবে। গতবারের তুলনায় এবারে ভোট দিতে এসেছিলেন বেশকিছু কম মানুষ।
পাঁচবছর আগের বিধানসভা নির্বাচনে মুঙ্গেরে ভোট পড়েছিল ৫৪.২৬ শতাংশ। এবারে তা অনেকটাই কমে দাঁড়ালো ৪৭.৮৯ শতাংশে। ওদিকে জামালপুরে মতদানের হার ৪৯.৭ থেকে কমে হয়েছে ৪৭.২৪ শতাংশ। একমাত্র ব্যতিক্রম তারাপুর বিধানসভা। সেখানে এবার ভোট পড়েছে ৫৪.৮ শতাংশ। গত নির্বাচনে তা ছিলো ৫২.৬৬ শতাংশ। প্রসঙ্গত, গড়পরতার হিসেবে প্রথম দফার নির্বাচনে ১৬ জেলায় ভোট পড়েছে ৫৩.৩৪ শতাংশ।
ভোটের পর চব্বিশ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই ফুঁসে উঠেছিলো মুঙ্গের। গত বৃহস্পতিবার মুঙ্গেরে যে জনবিস্ফোরণের ছবি দেখা গেলো, তা নীতিশ কুমারের উদ্বেগ বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। রাজ্য পুলিস প্রশাসনের বর্বরতা চোখ এড়ায়নি নির্বাচন কমিশনেরও। প্রথম দফার নির্বাচন সাঙ্গ হতেই কড়া পদক্ষেপের ঘোষনা করা হয়েছিলো। তবে ঘটনার পেছনে কোন রাজনৈতিক ইন্ধন কাজ করলো কিনা, আগামিদিনে তা পরিষ্কার হবে। ওদিকে এনডিএ বিরোধী শিবির যে মুঙ্গেরকান্ড নিয়ে শাসকদলকে কোণঠাসা করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে, তা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট।
হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি খোদ নির্বাচন কমিশন। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে ইতিমধ্যেই কমিশনের নির্দেশে সরে যেতে হয়েছে অভিযুক্ত ডিএম রাজেশ মীনা, এসপি মীনা সিংকে। সাতদিনের সময় বেঁধে গোটা ঘটনা তদন্তের রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মগধের ডিভিশনাল কমিশনারকে। মুঙ্গেরের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে নয়া ডিএম রচনা প্যাটেল, এসপি মনজিত সিং ধিলনের হাতে। "ঘটনার পেছনে দুষ্কৃতিদের হাত ছিল," ইতিমধ্যেই বলেছেন ডিএম। তিনি জানিয়েছেন, ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেই গন্ডগোল পাকানো হয়েছিল।
মুঙ্গেরকান্ড এনডিএ শিবিরের ওপর যে চাপ বাড়িয়েছে, প্রথম দফার নির্বাচনেই তা বোঝা গেছিলো। গোটা ঘটনা নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন নীতিশ কুমার। দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনে শোভাযাত্রার ওপর পুলিসের গুলি চালানোয়, বিরোধীশিবির ইতিমধ্যেই তাঁকে জেনারেল ডায়ারের আসনে বসিয়েছে। প্রথম দফার নির্বাচনী প্রচারে সে ব্যাপারে তিনি একটি কথাও বলেননি। তবে এনডিএ'র প্রবক্তা নিজেদের সাফাইয়ে যুক্তি খাড়া করেছিলেন। দাবি করা হয়েছিল, নির্বাচন চলায় রাজ্য পুলিস প্রশাসন রাজ্য সরকারের অধীনে নেই। পুলিসের রাশ নির্বাচন কমিশনের হাতে।
সোমবার রাত থেকে জমে থাকা ক্ষোভের বিস্ফোরণ হলো বৃহস্পতিবার। শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। রাস্তার দখল নেয় উন্মত্ত জনতা। তুমুল বিক্ষোভ দেখানো হয় এসপি, এসডিও'র দপ্তর, আবাসনের সামনে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় পুলিসের গাড়িতে। পুলিসি তৎপরতায় ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসে। শহরের রাস্তায় ফ্ল্যাগ মার্চ করতে দেখা যায় রাজ্য পুলিসকে। আপাতত শহরের পরিস্থিতি শান্ত, দাবি ডিএমের।
মানুষের ক্ষোভের রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে তৎপর এনডিএ বিরোধী মহাজোট। পাটনায় বসে নীতিশ কুমার, সুশীল মোদির সরকারকে উপড়ে ফেলার দাবি জানিয়েছেন কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালা। ঘটা করে সাংবাদিকদের ডেকে তিনি প্রশ্ন তোলেন, এসপি'র বর্বরতায় নীতিশ কুমার চুপ কেন? ওদিকে ইতিমধ্যেই কথা উঠেছে স্বজন পোষনের। অভিযুক্ত এসপি'র বাবা নীতিশ ঘনিষ্ঠ বলেই কি তাঁকে আড়াল করার চেষ্টা চলছে? দাবি জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপের।
ওদিকে এখনও কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় বিহার পুলিস। পুলিসের দাবি, সোমবার রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ দীনদয়াল উপাধ্যায় মোড়ে 'বড়ি মা দুর্গা' প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রায় গুলি চালিয়েছিল ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা দুষ্কৃতি। সেই গুলিতেই মারা যায় এক তরুন।
পুলিসের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ে শোভাযাত্রায় সামিল মানুষ। তখন আচমকাই ভিড়ের থেকে পুলিসকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়া হতে থাকে। তারপরেই পুলিস শোভাযাত্রীদের সরিয়ে দিতে লাঠি চালায়। ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হয় সোশাল মিডিয়ায়। ভিডিওতে দেখা যায় গুলির আওয়াজ শুনেই আতঙ্কের চোটে মানুষ যখন পালাতে ব্যস্ত, তখনও কিছু ভক্ত মূর্তি আগলাতে ব্যস্ত। ওই ভক্তদের ওপর কার নির্দেশে পুলিস ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মমভাবে লাঠিপেটা করে, সেই প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি পুলিস।
"শোভাযাত্রার ওপর পুলিসকে বলপ্রয়োগের কোনরকম নির্দেশ দেওয়া হয়নি," স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন ডিএম। মুঙ্গেরবাসীকে আশ্বস্ত করতে তিনি জানিয়েছেন, পুলিসের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হবে দোষীদের।
তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে, ঘটনা বাস্তবিকই তাৎক্ষণিক, নাকি নেপথ্যে কোনও উসকানি কাজ করেছিলো। নির্বাচনে মুঙ্গেরকান্ড কোনও সুদূরপ্রসারী ছাপ ফেললো কিনা, আগামিদিনে সেটাই দেখার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন