রবিবাসরীয় সাহিত্যের দিন প্রতিদিন

 

আমাদের নিয়মিত সাহিত্য সাধনার দিন প্রতিদিন  



আধুনিক বাংলা সাহিত্যের নবীন লেখক সন্দীপ চক্রবর্তী । সন্দীপ লেখেন, নিজের অনুভুতি দিয়ে। সেখানে পাওয়া যাবে নিজেকে খুঁজে। বর্তমানে সন্দীপ একটি সাপ্তাহিকপত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের অন্যতম । আজ তাঁর ধারাবাহিক থেকে একটু চোখ ফিরিয়ে আবার স্বাদ নিই  ধারাবাহিক উপন্যাসের।এবার থেকে  প্রতি রবিবার প্রকাশিত হবে এক একটি পর্ব। কারণ কিছুই নয় সন্দীপের উপন্যাসের এক একটি অধ্যায় মানে এক একটি গল্প। তাই রবিবাসরীয় একটা সাহিত্যের আড্ডা ভরানো থাক সন্দীপের উপন্যাসে।   



                            ঝুলবারান্দার নীচে#২৪




 সন্দীপ চক্রবর্তী 


ভেবেছিলাম সন্ধ্যে নামার আগে একবার বেরোব। আগেরবার মৌরিপুর গ্রামটা ভালো করে দেখা হয়নি বলে আফশোস ছিল। এবার সেটা সুদে আসলে মিটিয়ে নেব। কিন্তু মোহর আমাকে এমন এক টানাপড়েনের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে গেল যে বেরোতে পারলাম না।
মোহর যে শেষ পর্যন্ত ওর নিজের তৈরি করা দেওয়ালের বাইরের জগতটাকে বিশ্বাস করতে পেরেছে, ভরসা করতে পেরেছে-- সেটা আমার কাছে খুবই আনন্দের। সুতরাং, টানাপড়েন ওকে নিয়ে নয়। বসন্তবাবুকে নিয়ে। মানুষটাকে এক ভাবে দেখেছিলাম কিন্তু আজ মোহর অন্যভাবে দেখাল। এখন আমি যদি বলি, মোহর বিধবা বলে ওকে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান থেকে দূরে রাখাটা মোটেই মানবিক নয় বসন্তবাবু-- তিনি কি মানবেন? আবার তিনি না মানলে মোহরের ফিরে আসার ইচ্ছে হাউইয়ের মতো চোখে ধাঁধা লাগিয়েই নিভে যাবে। কোনওদিন আলোর পূর্ণতা পাবে না।
কূলকিনারা খুঁজে না পেলে সমুদ্রের মাঝি হাল ছেড়ে ভেসে থাকে। এক ঢেউ তাকে টানে আর অন্য ঢেউ তাকে ফিরিয়ে আনে। আমারও সেই দশা। বাবার প্রতি ওর অভিমান স্পষ্ট করে দিয়ে গেছে মোহর। আর আমার মতো একজন বাইরের লোকের কাছে ওর এতদিনের নীরবতা ভেঙে জানিয়ে দিয়ে গেছে, আমাকে ও বিশ্বাস করে। বিশ্বাস যে করে তার কোনও দায় থাকে না, বিশ্বাস যে রাখে সব দায় তার। আজ যদি আমি ওর বিশ্বাস রাখতে পারি তা হলে কাল ও মানুষকে বিশ্বাস করার শক্তি অর্জন করবে। আর সেটাই হবে ওর প্রকৃত ফেরা।
বসন্তবাবু বাড়িতে ছিলেন না। ফিরলেন সন্ধ্যে পার করে। এসেই বললেন, একা একা নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হচ্ছেন! আমার এমনই কপাল, বাড়িতে অতিথি এলেও মেয়েটা তার সঙ্গে দুটো কথা বলে না। যাক, আমি এসে গেছি। এবার আপনার সঙ্গে গপ্পগুজব করব।
যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, বসুন বসন্তবাবু। আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।
কী কথা সন্দীপবাবু। মোহরের কোনও ভুলচুক হয়নি তো?
না। মোহরের কোনও ভুলচুক হয়নি। মোহর আজ কথা বলেছে।
বসন্তবাবু আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলেন। বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা যখন পূরণ হয় তখন মানুষ চট করে তা বিশ্বাস করতে পারে না। স্বপ্ন আর বাস্তবের ভেদরেখাটি লুপ্ত হয়ে যায় মুহূর্তের জন্য। মন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে, আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? বসন্তবাবুও নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন করছেন। তাই আমি আবার কথাটা বললাম, হ্যাঁ, বসন্তবাবু। মোহর কথা বলেছে।
এরপর যা ঘটল তা আমি আশা করিনি। শিশুর মতো কাঁদতে শুরু করলেন বৃদ্ধ মানুষটি। আর বারবার বলতে লাগলেন, আমি জানতাম আপনি পারবেন। এত বয়েস হল, এত মানুষ দেখলাম। মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় না।
বিড়ম্বিত বোধ করছিলাম। কারণ যা ঘটেছে তার কৃতিত্ব আমার নয়। তাই মোহরের সঙ্গে আমার কী কথা হয়েছে তার সবিস্তার বর্ণনা দিয়ে বললাম, ও যা বলেছে সেটা কি ঠিক বসন্তবাবু?
ঠিকই তো বলেছে। তবে বলল যখন পুরোটা বললেই পারত। তাতে আপনি অন্তত আমায় ভুল বুঝতেন না। এই পর্যন্ত বলে বসন্তবাবু থামলেন। তারপর ম্রিয়মাণ হেসে বললেন, এ নিয়ম আমি তৈরি করিনি, সন্দীপবাবু। আমার বাবার ঠাকুমা তৈরি করেছিলেন। তাকে আমি দিদি বলতাম। খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির মহিলা। বাড়ির সবাই ওকে যমের মতো ভয় করত। যাকে কেন্দ্র করে এই নিয়মের সূত্রপাত তিনি আমার এক পিসিমা। ছোটবেলা থেকেই কৃষ্ণভক্ত। কৃষ্ণের গানও খুব ভালো গাইতেন। গান গেয়ে সকালে গোপালের ঘুম ভাঙানো আর রাতে ঘুম পাড়ানো ছিল তার রোজের কাজ। চোদ্দ বছর বয়েসে বিয়ে হয়েছিল পিসিমার। আর বিধবা হয়ে ফিরে এসেছিলেন আট মাস পর। আমি তখন দশ-বারো বছরের। কিন্তু এখনও মনে আছে দিদির কথাগুলো। পান চিবুতে চিবুতে একরত্তি মেয়েটাকে বলেছিলেন, সাদা পরে যখন ফিরে এসেছ তখন আর মন্দিরে ঢুকো না। আমার গোপাল সাদা মোটে সহ্য করতে পারে না। সেই থেকে চলছে এই নিয়ম।
মোহরের কথা শুনে বসন্তবাবু সম্বন্ধে সত্যিই আমার মনে একটা ভুল ধারণা হয়েছিল। সেটা কেটে গেল। বললাম, সেদিন আপনার পিসিমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছিল। আমাদের দুর্ভাগ্য সেইসময় এই ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস খুব বেশি মানুষের থাকত না। কিন্তু এখন আছে। বাবা হয়ে আপনি নিশ্চয়ই চাইবেন না যে একই অন্যায় মোহরের সঙ্গেও হোক।
চাইনি কোনওদিন। এখনও চাই না। আপনি বিশ্বাস করুন। কিন্তু কী করব! পাঁচজনে পাঁচকথা বলে। মেয়ের চরিত্র সম্বন্ধে অপবাদ দেয়। তাই ইচ্ছে না হলেও মানতে হয়।
না বসন্তবাবু। মোহরকে যদি স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চান তা হলে ওকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দিতে হবে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বসন্তবাবু বললেন, ঠিক আছে। কিন্তু তার জন্য আপনাকে একটা কঠিন কাজ করতে হবে।
কী কাজ?
আমাদের কুলগুরু রামকিশোর ভটচায্যি মশাইকে রাজি করাতে হবে। তিনি পণ্ডিত মানুষ। বয়েসও প্রায় সাতাশি হতে চলল। কিন্তু এখনও সেই আগেকার মতো জেদি আর একগুঁয়ে। দিদির নিয়ম যে আজও এ বাড়িতে চলছে তার একটা প্রধান কারণ আমাদের ভটচায্যি মশাই। তিনি ছিলেন দিদির প্রিয়পাত্র। তিনিও দিদির মতো বিশ্বাস করেন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বিধবার কোনও অধিকার নেই। আপনি যদি ওকে রাজি করাতে পারেন, তা হলে কথা দিচ্ছি এ বাড়িতে ওই নিয়ম আর থাকবে না।
অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু এ কাজ তো আপনার বসন্তবাবু! নিয়ম আপনাদের বাড়ির, কুলগুরু আপনার বংশের, তা হলে আমি কেন তাকে রাজি করাতে যাব?
বসন্তবাবু মাথা নীচু করে বললেন, কারণ ভটচায্যি মশাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এ সব কথা বলার সাহস আমার নেই। আমার অনুরোধ শুধু মোহরের মুখ চেয়ে আপনি এই কাজটা করে দিন।
অন্য কেউ এই অনুরোধ করলে নিশ্চিত এড়িয়ে যেতাম। কারোও ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। এখানে বিষয়টা আলাদা৷ যাকে মনে মনে বন্ধু মেনেছি, বিপদে-আপদে-সংকটে তার পাশে থাকা আমার ধর্ম। আমার সত্য। আমার ন্যায়। বসন্তবাবুরা ধর্ম বলতে শুধু উপাসনা পদ্ধতি বোঝেন। সত্যের প্রতি যদি তার বিন্দুমাত্র আস্থা থাকত তা হলে বুঝতে পারতেন নিষ্ঠুর নিয়মের জাঁতাকলে বারবার কাউকে বৈধব্যের কথা স্মরণ করিয়ে আর যাই হোক তাকে বৈধব্যযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়া যায় না।
ঠিক আছে। কাল আমি আপনার কুলগুরুর সঙ্গে কথা বলব।
বসন্তবাবু আমার হাত ধরে বললেন, আপনার সব শক্তি লাগিয়ে দিন। আমাদের বাপ-বেটিকে বড্ড কষ্ট দিয়েছে লোকটা। কোনওদিন কিচ্ছু বলতে পারিনি৷
গলা ধরে গেল বসন্তবাবুর। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আচমকাই। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ওর পালিয়ে যাওয়ার হতমান ভঙ্গীটির দিকে। এই আমার দেশ। এই আমার দেশের মানুষ। যুগ যুগ ধরে এরকম কত অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে গেল কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। ধর্ম জানল না। সত্য চিনল না। শুধু মানল আর মানিয়ে নিল।

(ক্রমশ)

মন্তব্যসমূহ