রবিবাসরীয় বিশেষ ঃ দেবব্রত বিশ্বাস
।। সেও ছিলো এক নেপোটিজমের কাহিনি ।।
কাজল ভট্টাচার্য, কলকাতা
(শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের দাপুটে কন্ঠ ঘাড়ে ধরেই শিখিয়েছিল- বাপু হে, রবীন্দ্রসঙ্গীতটা শুনতে হবে। শুনেছিলাম। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গেই শুনেছিলাম শিল্পীকন্ঠের পৌরুষ। সেই শিল্পীকেই যেতে বাধ্য করা হয়েছিল স্বেচ্ছা নির্বাসনে। তবে আজকে লেখার বিষয় একেবারেই অন্য।)
যখন তিনি দাপটে গেয়ে চলেছেন, ঠিক তখনই তাঁকে পাঠানো হলো স্বেচ্ছা নির্বাসনে।
সেও তো এক নেপোটিজমের কাহিনি।
প্রতিষ্ঠানের দম্ভে গান রেকর্ড করা থেকে সরে এসেছিলেন এক অভিমানী শিল্পী।
সেদিন মিডিয়ার এতো বাড়াবাড়ি ছিলো না। নইলে হয়তো সে সময়কার অনেক নামীদামীদের মুখোশ খসে যেত। বিশ্বভারতী তখন শুধু রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকারীই না, অভিভাবকও। সেই ঠিক করে দিতো রবীন্দ্রচর্চার কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক। শাসকের ওই অচলায়তন চুরমার করে, কীভাবে কোনও অতি সাধারণ মানুষকে রবীন্দ্রমুখী করা যায়, আজ সেই গল্পই শোনাবো।
শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে পরিচয়ের কথা বলি। আমি প্রবাসী বাঙালি। রবিবার হলেই ঠিক সকাল দশটা নাগাদ আমাদের বাড়িতে এক আসর বসতো গান শোনার। আমরা তখন সবে কলেজে পা রেখেছি। ঠিক এমন সময়ে গান শোনার ব্যাপারটাই যেন আমূল পাল্টে দিলো স্টিরিও সাউন্ড সিস্টেম। গমগমে আওয়াজ।
পুজোর মুখেই বাড়িতে ফিলিপসের স্টিরিও সেট এলো। সঙ্গে বেশকিছু রেকর্ডও। পুজো সংখ্যার কিশোর আশা লতা পঞ্চম ছাড়া আর কারও বাংলা গান, সেদিনের সেই 'ছোকরা আমাদের' টানতো না। আমাদের সবারই পছন্দ ছিল ভারী বজ্রগম্ভীর গলা। কিশোর কুমারের গলায় সেই মাদকতা খুঁজে পেতাম আমরা। হঠাত একটা রেকর্ড কভার চোখ টানলো। ভারী সুন্দর একটা মেয়ের ছবি। শিল্পীর নামটা দেখলাম দেবব্রত বিশ্বাস। ইপি রেকর্ড। স্পষ্ট মনে পড়ে, কভারের ওপর লেখা ছিলো- আমার যে দিন ভেসে গেছে।
ছবি আঁকার নেশা ছিলো। ওই সুন্দর ছবি দেখেই ভেবেছিলাম, দেখি তো রেকর্ডের গানটা কেমন? কে এই দেবব্রত বিশ্বাস?
তখনও রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গান, টপ্পা আঙ্গিক ওসব বুঝি না। বেহালার চাপা করুন সুর। শিল্পী সুর ধরলেন। বেশ তো গলাটা! পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু বড্ড স্লো। সে অর্থে প্রিলিউড ইন্টারলিউড যেন থেকেও নেই। কঙ্গো বঙ্গো ঢোলক তো দূরের কথা, ডুগি তবলার তা ধিন তাকও নেই। এমনকি রেকর্ডিংটাও স্টিরিও না। কোনও আয়োজন ছাড়াই, শুধু ভরাট গলাতেই ছক্কা খেললেন দেবব্রত বিশ্বাস।
অন্তরায় এলেন শিল্পী। ধরলেন, 'আজি পূবের হাওয়ায় হায় হায়...!' কেঁপে গেলাম। সেই বয়সে গোটাটাই ছিলো শুদ্ধ আবেগ। মগজ দিয়ে সুর বিচারের বিদ্যাবুদ্ধিও ছিলো না। শুধু এটুকু বুঝলাম, দেবব্রত বিশ্বাসের একবুক উজাড় করা 'হায় হায়', ঘা মেরে গেলো বুকের ভেতরটায়।
বুকের ভেতর সুপ্ত ব্যর্থপ্রেমের জ্বালা না থাকলে, ওই সুরের আর্তি লাগে কি?
একটুও অপেক্ষা না করে এবার শুনে ফেললাম- 'নয়ন ছেড়ে গেলে চলে।'
'...শ্রবণে মোর নব নব শুনিয়েছিলে যে সুর তব!' শিল্পীর গলা যেন আকাশ ছুঁয়ে নেমে এলো। তারপরেই ধীর স্বরে, 'বীণা থেকে বিদায় নিল চিত্তে আমার বাজে।'
এবার নিজেই একটা লং প্লে রেকর্ড কিনে আনলাম দেবব্রত বিশ্বাসের। প্রথমেই শুনলাম, 'পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে"। এই গানের বেশ একটা গতি ছিলো। শব্দে শব্দে সেই আকূলতা। প্রেমের এক অপূর্ব ছবি আঁকা হয়ে গেছিলো আমাদের মনে। এরপর থেকেই সেই 'প্রবাসী বাঙালি ছোকরাদের' আসরে দিব্য গেড়ে বসলেন শিল্পী। এক অদ্ভুত ঠাট, পৌরুষ। পুরুষের প্রেম, পুরুষের আবেগ ওরকম হলেই মানায়।
আবার সেই পুরুষই স্থিতধী 'যতবার আলো জ্বালাতে চাই' বা 'আছে দুঃখ আছে মৃত্যু'-তে। মন ভার হয় না সেই মৃত্যুতে, মন ভরে যায়। 'বাজে নাই বাঁশি সাজে নাই গেহ!' কী অপার্থিব আত্মসমাপন। 'মা' ডাকটা যে ঠিক তাঁর মতো করে কেউ ডাকতে পারেন না, তা দেবব্রত বিশ্বাস নিজেও জানতেন। ঋত্ত্বিক ঘটকের 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে 'কেন চেয়ে আছ গো মা' গানে দেবব্রতর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন সুশীল মল্লিক। যতদূর জানি, গানে যতবার মা শব্দটা এসছে ততবারই শোনা গেছিল দেবব্রতর গলা।
'মেঘে ঢাকা তারা'তেও সেই পৌরুষ আর আবেগ নিয়ে হাজির শিল্পী। কী নিখুঁত অভিনয় শব্দে শব্দে। তিনি চাইলে আগুন জ্বালান-'.. বুঝিবা এই বজ্র রবে নূতন পথের বার্তা কবে..।' আবার তিনিই আগুনে জল ঢালেন-'..না না গো না কোরো না ভাবনা..।'
আর এক চমক তখনও অপেক্ষা করে। শুনলাম 'উইথ আ হাই হোপ'। বাপরে বাপ একেই বোধহয় বলে ব্যারিটোন ভয়েস। পাশ্চাত্ত্য বিশেষ করে ব্ল্যাক আমেরিকান গায়কদের অমন বজ্রগম্ভীর গলা শুনেছি বৈকি। 'বড়ো আশা করে'তেও গলার সেই জলদগম্ভীর ব্যাপারটা ধরা পড়লো, '..ওই যে হেরী তমসঘনঘোরা গহন রজনী..।'
অনেক পরে জেনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাস নির্ভেজাল বাঙালভাষা ছাড়া কথা বলতেন না। অবাক হয়ে গেছিলাম সেই বাঙালের মুখে ওই সাহেবি অ্যাকসেন্টে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ইংরেজি ভার্সান শুনে।
তবে শেষ করার আগে 'মম দুঃখের সাধন'- এর কথা না বললেই নয়। দেবব্রত বিশ্বাস প্রয়াত হওয়ার পর ওই নামেই বেরিয়েছিল এক ক্যাসেট। তাতে পরিষ্কার ভাবেই বলা ছিল, গানগুলি ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে নেওয়া। প্রথম গানটাও ছিল, 'মম দুঃখের সাধন'। ঘরোয়া পরিবেশে গাওয়া সেইসব গানের অনুভূতিটাই আলাদা। শিল্পী যেন আপনজন। পাশের বাড়ির কাকু।
'প্রেমের অভিষেক, কেন হলো না তব নয়নজলে!' এই প্রশ্নটা ঠিক কাকে করে গেছিলেন শিল্পী? বুকের ভেতর ব্যর্থ প্রেমের জ্বালা না থাকলে অমন 'হায় হায়' বেরোয় কীভাবে?
তখন চল্লিশ ছাড়িয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস। বাইক দাপিয়ে বেড়ান শহরে। হঠাত তাঁর বাইকের পেছনের সিটে দেখা যেতে লাগলো এক সপ্রতিভ চেহারার মহিলাকে। গতির পিঠে সওয়ার দুজনে আজ ময়দানে তো কাল গঙ্গার ঘাটে। কে ইনি? অনেকের কৌতুহল জাগলো। মহিলাটি ছিলেন প্রেসিডেন্সির ছাত্রী। নাম মঞ্জুশ্রী চাকী। দুজনের প্রথম দেখা এলিট সিনেমা হলের মঞ্চে। সালটা ছিল ১৯৫২। দেবব্রত ধরলেন 'নৃত্যের তালে তালে'। মঞ্জুশ্রী পায়ে ছন্দ মিলিয়ে ঝড় তুললেন শরীরে। সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখলেন দেবব্রত- মঞ্জুশ্রী জুটির গান- নাচের সেই অনুষ্ঠান। তখনকার পত্র- পত্রিকায় ওই খবর ছাপা হতো বেশ ঘটা করেই।
তারপর একদিন মঞ্জুশ্রী চলে গেলেন বিদেশে। স্বামীর ঘর করতে। ফের শহরের রাস্তায় একা দেখা গেলো শিল্পীকে। শিল্পী গাইলেন, 'হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয় আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়..!'
'প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমই আমাকে নতুন অহঙ্কার দেয়/ আমি মানুষ হিসবে একটু লম্বা হয়ে উঠি..' লিখেছিলেন প্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়। দেবব্রত বিশ্বাসের মতো মানুষরা বোধহয় তাই হন। আর তাই আবেগ কোথাও তাঁর কন্ঠের পৌরুষত্বকে খর্ব করতে পারেনি।
দেবব্রত বিশ্বাস যেন ঘাড় ধরে শিখিয়েছিলেন, বাপু হে রবীন্দ্রসঙ্গীতটা শুনতে হবে।
এরপর এলো শিল্পীকে আত্মস্থ করার পালা। জীবনে যা কিছু প্রিয়, মানুষ তাকেই আরও নিবিড় করে পাওয়ার নানা অজুহাত খুঁজতে থাকে। বামপন্থায় বিশ্বাসী শিল্পী। গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম। তবু আস্থা অবিচল রবীন্দ্রনাথে। বামপন্থীদের মঞ্চে বসেও অবলীলায় শুনিয়েছেন গুরুদেবের গান। ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৫৪ পর্যন্ত বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেন, কিন্তু দলের খাতায় নাম লেখালেন না।
তবে ষাটের দশক থেকেই গুটিয়ে নিলেন গণসঙ্গীত থেকে। মুক্তমনা শিল্পীর ধাতে সইলো না রাজনৈতিক সখ্যতা। বামপন্থীদের ভাঙন মেনে নিতে পারেননি তিনি এমনটাই মত অনেকের। ওদিকে বিশাল এক আঘাত এলো বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে। দেবব্রত বিশ্বাসের গায়কী, যন্ত্রানুষঙ্গে অরাবীন্দ্রিক উপকরণ আবিষ্কার করলেন বোর্ডের গুণীজনরা। সাল ১৯৬৪। শিল্পীর দুটো গান অনুমোদন পেলো না। ১৯৬৯ তেও ফের একই ঘটনা। এবার রেকর্ড করা বন্ধ করলেন দেবব্রত। তখন তিনি টপ ফর্মে। বন্ধ হয়ে গেলো বেদগানের স্রোত। রেকর্ড বিক্রির রয়্যালটি পাওয়ায় তিনিই তখন এক নাম্বারে। দেবব্রত বিশ্বাসের ওই জনপ্রিয়তাই সম্ভবত সহ্যের বাইরে চলে গেছিল বোর্ড কর্তাদের, এরকমটাই সন্দেহ করেছিলেন অনেকে।
'অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য!' এমনই কোনও মুহূর্তের কথা ভেবে লিখেছিলেন কবি সুনীল গঙ্গ্যোপাধ্যায়। এবার নিজেই কলম, হারমোনিয়াম ধরলেন। সালটা ছিল ১৯৮০। বিশ্ববাসীকে জানিয়ে গেলেন সেই নেপোটিজমের কাহিনি- 'ক্যারে হ্যারা আমারে গাইতে দিলো না।'
তথ্য সমৃদ্ধ লেখা।
উত্তরমুছুন