প্রয়াত জননেতা সোমেন মিত্র
কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা
( লেখক সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হয়ে সোমেন মিত্রকে প্রথমবার দেখার অনুভুতি কেমন ছিল , সেটাই জানালেন ,তাকে শ্রদ্ধা জানাতে )
একেবারে হাত কয়েকের মধ্যেই সোমেন মিত্র।
এ সেই চেনা বামপন্থী ভাবগম্ভীর চেহারা না। বেশ কবজির জোরওয়ালা এক মানুষ। কথাবার্তাতেও সেই বামপন্থী সফিসটিকেশন ছিলো না। আমার আপনার মতোই একজন। না, ঠিক তাও না। বরাবরই আমার খুব পছন্দের সাদা ধবধবে আদ্দির পাঞ্জাবি ধুতি। বাঙালি বাবুয়ানা বা আভিজাত্য, যাই বলুন না কেন। সোমেন মিত্রর ওই পোশাক আশাক বরাবরই আমায় টানতো। আর ওই টানটা ছিলো বলেই, সেদিন ওই কার্টুনগুলি বেশ জমিয়ে এঁকে ফেলেছিলাম।
বসেছিলাম সোমেন মিত্রর আমহার্স্ট স্ট্রিটের অফিসে। যারাই আসে ছোড়দা বলে ডাকেন। তবু ওই ডাকের আড়ালে এক সমীহ কাজ করছিলো বলেই আমার ধারনা। ছোড়দা মানেই নিশ্চয়ই ঘনিষ্ঠজন। আর আমি অজ্ঞাত কুলশীল তো বটেই। আর যে কাজটা করার পর ওঁর আমহার্স্ট স্ট্রিটের অফিসে গেছিলাম, সত্যি বলতে কী সেই কাজটা ছিল সোমেন মিত্রর খিল্লি করা। উনি মাথা গরম করে ফেললেই বিপদ। স্বাভাবিকভাবেই বেশ একটু ভয় ভয় লাগছিলো। কী জানি কখন কী করে বসেন।
ঘটনা খুলেই বলি। তখন আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল কলেজ স্ট্রিটে। সেখান থেকে বেরোত এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। পরে অবশ্য তা প্রতি সপ্তাহে বেরোত না। সেই ম্যাগাজিন বার করেছিল সোমেন মিত্র সংখ্যা। সেই সংখ্যায় বেশ কয়েকটা মারকাটারি কার্টুন এঁকেছিলাম সোমেনবাবুর। তারমধ্যে উঠে এসছিলো তাঁর সেই বিখ্যাত কালীপুজোর কথাও।
নব্বইয়ের দশক। তখন বাংলা বামপন্থীদের দখলে। রাজপাট গুটিয়েছে কংগ্রেস। আমার বয়সও তিরিশের কোঠায়। আমার সেই প্রজন্মের কাছে তখন বামপন্থী বিশেষ করে সিপিএম ছিলো এক আবেগ। ওদিকে মানুষ তখন কংগ্রেস বলতেই বোঝে সোমেন মিত্র। সেই বামপন্থী আবেগ নিয়ে বাংলায় কংগ্রেসের মুখ সোমেন মিত্রর কার্টুন আঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমার আঁকা কার্টুনগুলিতে খোঁচাটাও ছিল তীব্র।
মনে পড়ে গেল পোরাসের কথা- রাজার কাছে রাজার সম্মান চাই। সোমেন মিত্র পরাজিত রাজা পোরাস হতেই পারেন। কিন্তু বামপন্থী সমর্থক হিসেবে, আমি তো বিজয়ী রাজা আলেকজান্ডারের মতো উদার ছিলাম না। তবে সোমেন মিত্রকে পরাজিত রাজা এজন্যই বললাম, কারণ তিনি নিজে তখনও শিয়ালদহর বিধায়ক হলেও, তাঁর দলকে জেতাতে পারেননি। অথচ কংগ্রেসের সেনাপতি হিসেবে, প্রদেশ সভাপতির কুর্সিতেও তিনি।
যেহেতু বামপন্থী রাজনীতিতে ভরসা করতাম, তাই ভগবান পুজোপাঠ মানেই তেরছা চোখের দৃষ্টি। বেপরোয়া রসিকতা। তাই নিশানা করেছিলাম, তাঁর বিখ্যাত কালীপুজোকে। বিশালবপুর সোমেন মিত্র। কার্টুনের কোথাও তিনি যেন জহ্লাদ। খড়্গ হাতে তাড়া করছেন তখনকার এক নামজাদা সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীকে। আবার কোথাও পুরোহিত। মাকালীর কাছে প্রার্থনা করছেন বামপন্থী জমানার অবসানের। আবার অন্য আর এক কার্টুনে ঠুঁটো জগন্নাথ। এরকম কত কী! পঁচিশ তিরিশবছর আগের কথা। আজ আর সেভাবে মনেও পড়ে না।
কলকাতা তখন আমার কাছে নতুন। শহরের রাস্তাঘাটও আমার কাছে গোলকধাঁধাঁর মতো। আমার বামপন্থী বন্ধুরাও সেদিন ওই ম্যাগাজিনের কার্টুনগুলি দেখে সাবধান করে দিয়েছিল- সাবধানে চলাফেরা করিস। সেই থেকেই বেশ ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করতাম। এরমধ্যেই ঘটলো আর এক ঘটনা। সোমেন মিত্র সংখ্যা বেরনোর দু- চারদিন পরেই সেই ম্যাগাজিনের অফিসে গেছি। এক মহিলা সহকর্মী যে ওই সংখ্যায় সোমেন মিত্রকে নিয়ে লিখেছিল, একগাল হেসে জানালো 'ছোড়দা' তোমার কথা জানতে চাইছিল। ব্যাস, দড়াম করে বুকের মধ্যে কেউ হাতুড়ির এক ঘা বসিয়ে দিলো। ওদিকে তখনও সেই মহিলা বলেই চলেছে, "তোমাকে নিয়ে একদিন যেতে বলেছে।"
চাপা উত্তেজনা বুকের মধ্যে। কী হতে চলেছে? বামপন্থী বন্ধুদের হুঁশিয়ারির কথা মনে পড়ে গেল। সাধ করে কেন নিজের মরণ ডাকলাম কে জানে! ভগবান বিশ্বাস টিশ্বাস কোনদিনই ছিলো না। কিন্তু সে মুহূর্তে সেই ভগবানকেই ডাকলাম। সামনেই ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। মনেমনে তাকেই স্মরণ করলাম। "কলেজ স্ট্রিট তো শুধু সোমেন মিত্রর জমিদারী না। তোমারও মা। সোমেন মিত্রর কোপ থেকে বাঁচাও মা।"
সোমেন মিত্রর বাড়ি যাব না, বলতেও ইগোতে লাগছে। সবাই ভাববে, ভয় পেয়ে গেছি। ওদিকে ভেতরটা তখন শুকিয়ে কাঠ। অফিসের আর সবাই তখন বলে চলেছে- ফাটিয়ে এঁকেছিলে বস। ছোড়দা খুব প্রশংসা করেছে। তেতো গেলার মতো সব তারিফ হজম করা ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না।
অতএব ঠিক হলো, পরদিন এগারোটা নাগাদ যাওয়া হবে।
সেদিন আমার সঙ্গী যেভাবে সোমেন মিত্রর দপ্তরে প্রবেশ নিয়েছিল, তাতে বুঝতে পেরেছিলাম দুজনেই বেশ কাছের মানুষ। সান্ত্বনা বলতে তখন ওটুকুই।
- আরে বসো বসো। বললেন রক্তমাংসের সোমেন মিত্র।
বুকটা তো তখন ধক করে উঠেছিল জানি। কিন্তু আমার মুখটাও কি তখন শুকিয়ে গেছিল? জানি না। তবে আমহার্স্টের 'ছোড়দা' আমায় দেখে একটু হাসলেন। সরল নিষ্পাপ বা ভদ্রতাসূচক হাসি না একেবারেই। বরং হাসির ভাষাটা ছিল যেন দুষ্টুমিতে ভরা। যেন তিনিও বললেন- কী কেমন মজা?
এরপরেই বললেন- দাঁড়িয়ে কেন, বসে পড়ুন।
স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলাম আমিও। তিনি তখন অন্য আর একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারও বেশ মস্তানের মতো লুক। কথা থামিয়ে সোমেনবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন- চিনিস উনি কে?
আমার মুখের দিকে দুজোড়া চোখের ফোকাস টেবিলের উল্টো দিকের। আমিও কম যাই না। ছোট্ট করে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি ঠোঁটে। সোমেন মিত্র তাঁর সেই শাগরেদকে ম্যাগাজিনের নাম করে বললেন- আমার যে কার্টুনগুলি দেখলি, সবগুলি ওর আঁকা।
ক্লাইম্যাক্সের শেষ ধাপ।
মনকে সান্ত্বনা দিতে জওহররলাল নেহরুর কথা ভাবলাম। তখন আসমুদ্র হিমাচল কংগ্রেস রাজ। কার্টুন সবসময় শাসকদের নিয়েই আঁকার রেওয়াজ। তার ওপর নেহরুর জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে। সেই নেহরুকে নিয়ে প্রায় হাজার চারেক কার্টুন এঁকে ফেলেছিলেন কেশব শঙ্কর পিল্লাই। দুনিয়া যাকে চেনে শঙ্কর নামে। কিন্তু কোনও কারণে বেশ কিছুদিন সেই ইংরেজি দৈনিকে নিজের কার্টুন চোখে পড়ছিল না নেহরুর। ডাক পড়লো কার্টুনিস্টের। নেহরু জানতে চাইলেন- আমার কি জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে? এরপরেই বলেছিলেন- ডোন্ট স্পেয়ার মি শঙ্কর। আশা করলাম, সোমেন মিত্রও আমাকে সেরকম কিছু জিজ্ঞেস বলবেন।
আমার পরিচয় দিয়েই হেসে উঠলেন সোমেন মিত্র। দপ্তরের অন্যরাও তাতে যোগ দিলো। একমাত্র আমি বাদ। এবার মনে পড়ে গেল 'শোলে' সিনেমার গব্বর সিংয়ের সেই অট্টহাসি। আমি যেন কালিয়া। অপেক্ষা করছি, কখন সোমেন মিত্র বলেন- যো ডর গয়া, ও মর গয়া। না সেসব কিছু হলো না। তিনি এও বললেন না- অব গোলি খালে। বরং সোমেন মিত্র জানতে চাইলেন, কী খাবো। আর ঠিক তখনই চা হাজির।
"আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম যে আপনি শিল্পী।" হাসতে হাসতে বললেন বাংলার কংগ্রেসের মুখ। "একেবারে আমার ধুতির কাছা খুলে দিয়েছিলেন।" ততক্ষণে আমিও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছি। কোথায় থাকি, কী করি, অনেক খবরাখবর নিলেন। বেশ একটা গার্জিয়ানসুলভ হাবভাব। নেহরুজিকে আমি দেখিনি। তাঁর কার্টুনিস্টের ওপর দরাজ দিল হওয়ার কথা বইয়ে পড়েছিলাম। সোমেন মিত্রও ঠিক সেরকম কিনা তখনও জানি না। তবে ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরে গেছি, সামনের এই ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষটা আমার কোনও ক্ষতি করতে পারে না। সেমুহূর্তে আমারও ইচ্ছে করছিল, ওঁকে একবার 'ছোড়দা' বলে ডাকি।
।। সোমেন মিত্র থেকে ছোড়দা, যেমন দেখেছিলাম ।।
কাজল ভট্টাচার্য , কলকাতা
( লেখক সংবাদপত্রের প্রতিনিধি হয়ে সোমেন মিত্রকে প্রথমবার দেখার অনুভুতি কেমন ছিল , সেটাই জানালেন ,তাকে শ্রদ্ধা জানাতে )
একেবারে হাত কয়েকের মধ্যেই সোমেন মিত্র।
এ সেই চেনা বামপন্থী ভাবগম্ভীর চেহারা না। বেশ কবজির জোরওয়ালা এক মানুষ। কথাবার্তাতেও সেই বামপন্থী সফিসটিকেশন ছিলো না। আমার আপনার মতোই একজন। না, ঠিক তাও না। বরাবরই আমার খুব পছন্দের সাদা ধবধবে আদ্দির পাঞ্জাবি ধুতি। বাঙালি বাবুয়ানা বা আভিজাত্য, যাই বলুন না কেন। সোমেন মিত্রর ওই পোশাক আশাক বরাবরই আমায় টানতো। আর ওই টানটা ছিলো বলেই, সেদিন ওই কার্টুনগুলি বেশ জমিয়ে এঁকে ফেলেছিলাম।
বসেছিলাম সোমেন মিত্রর আমহার্স্ট স্ট্রিটের অফিসে। যারাই আসে ছোড়দা বলে ডাকেন। তবু ওই ডাকের আড়ালে এক সমীহ কাজ করছিলো বলেই আমার ধারনা। ছোড়দা মানেই নিশ্চয়ই ঘনিষ্ঠজন। আর আমি অজ্ঞাত কুলশীল তো বটেই। আর যে কাজটা করার পর ওঁর আমহার্স্ট স্ট্রিটের অফিসে গেছিলাম, সত্যি বলতে কী সেই কাজটা ছিল সোমেন মিত্রর খিল্লি করা। উনি মাথা গরম করে ফেললেই বিপদ। স্বাভাবিকভাবেই বেশ একটু ভয় ভয় লাগছিলো। কী জানি কখন কী করে বসেন।
ঘটনা খুলেই বলি। তখন আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল কলেজ স্ট্রিটে। সেখান থেকে বেরোত এক সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন। পরে অবশ্য তা প্রতি সপ্তাহে বেরোত না। সেই ম্যাগাজিন বার করেছিল সোমেন মিত্র সংখ্যা। সেই সংখ্যায় বেশ কয়েকটা মারকাটারি কার্টুন এঁকেছিলাম সোমেনবাবুর। তারমধ্যে উঠে এসছিলো তাঁর সেই বিখ্যাত কালীপুজোর কথাও।
নব্বইয়ের দশক। তখন বাংলা বামপন্থীদের দখলে। রাজপাট গুটিয়েছে কংগ্রেস। আমার বয়সও তিরিশের কোঠায়। আমার সেই প্রজন্মের কাছে তখন বামপন্থী বিশেষ করে সিপিএম ছিলো এক আবেগ। ওদিকে মানুষ তখন কংগ্রেস বলতেই বোঝে সোমেন মিত্র। সেই বামপন্থী আবেগ নিয়ে বাংলায় কংগ্রেসের মুখ সোমেন মিত্রর কার্টুন আঁকা। স্বাভাবিকভাবেই আমার আঁকা কার্টুনগুলিতে খোঁচাটাও ছিল তীব্র।
মনে পড়ে গেল পোরাসের কথা- রাজার কাছে রাজার সম্মান চাই। সোমেন মিত্র পরাজিত রাজা পোরাস হতেই পারেন। কিন্তু বামপন্থী সমর্থক হিসেবে, আমি তো বিজয়ী রাজা আলেকজান্ডারের মতো উদার ছিলাম না। তবে সোমেন মিত্রকে পরাজিত রাজা এজন্যই বললাম, কারণ তিনি নিজে তখনও শিয়ালদহর বিধায়ক হলেও, তাঁর দলকে জেতাতে পারেননি। অথচ কংগ্রেসের সেনাপতি হিসেবে, প্রদেশ সভাপতির কুর্সিতেও তিনি।
যেহেতু বামপন্থী রাজনীতিতে ভরসা করতাম, তাই ভগবান পুজোপাঠ মানেই তেরছা চোখের দৃষ্টি। বেপরোয়া রসিকতা। তাই নিশানা করেছিলাম, তাঁর বিখ্যাত কালীপুজোকে। বিশালবপুর সোমেন মিত্র। কার্টুনের কোথাও তিনি যেন জহ্লাদ। খড়্গ হাতে তাড়া করছেন তখনকার এক নামজাদা সিপিএম নেতা সুভাষ চক্রবর্তীকে। আবার কোথাও পুরোহিত। মাকালীর কাছে প্রার্থনা করছেন বামপন্থী জমানার অবসানের। আবার অন্য আর এক কার্টুনে ঠুঁটো জগন্নাথ। এরকম কত কী! পঁচিশ তিরিশবছর আগের কথা। আজ আর সেভাবে মনেও পড়ে না।
কলকাতা তখন আমার কাছে নতুন। শহরের রাস্তাঘাটও আমার কাছে গোলকধাঁধাঁর মতো। আমার বামপন্থী বন্ধুরাও সেদিন ওই ম্যাগাজিনের কার্টুনগুলি দেখে সাবধান করে দিয়েছিল- সাবধানে চলাফেরা করিস। সেই থেকেই বেশ ভয়ে ভয়ে চলাফেরা করতাম। এরমধ্যেই ঘটলো আর এক ঘটনা। সোমেন মিত্র সংখ্যা বেরনোর দু- চারদিন পরেই সেই ম্যাগাজিনের অফিসে গেছি। এক মহিলা সহকর্মী যে ওই সংখ্যায় সোমেন মিত্রকে নিয়ে লিখেছিল, একগাল হেসে জানালো 'ছোড়দা' তোমার কথা জানতে চাইছিল। ব্যাস, দড়াম করে বুকের মধ্যে কেউ হাতুড়ির এক ঘা বসিয়ে দিলো। ওদিকে তখনও সেই মহিলা বলেই চলেছে, "তোমাকে নিয়ে একদিন যেতে বলেছে।"
চাপা উত্তেজনা বুকের মধ্যে। কী হতে চলেছে? বামপন্থী বন্ধুদের হুঁশিয়ারির কথা মনে পড়ে গেল। সাধ করে কেন নিজের মরণ ডাকলাম কে জানে! ভগবান বিশ্বাস টিশ্বাস কোনদিনই ছিলো না। কিন্তু সে মুহূর্তে সেই ভগবানকেই ডাকলাম। সামনেই ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি। মনেমনে তাকেই স্মরণ করলাম। "কলেজ স্ট্রিট তো শুধু সোমেন মিত্রর জমিদারী না। তোমারও মা। সোমেন মিত্রর কোপ থেকে বাঁচাও মা।"
সোমেন মিত্রর বাড়ি যাব না, বলতেও ইগোতে লাগছে। সবাই ভাববে, ভয় পেয়ে গেছি। ওদিকে ভেতরটা তখন শুকিয়ে কাঠ। অফিসের আর সবাই তখন বলে চলেছে- ফাটিয়ে এঁকেছিলে বস। ছোড়দা খুব প্রশংসা করেছে। তেতো গেলার মতো সব তারিফ হজম করা ছাড়া আর উপায়ও ছিলো না।
অতএব ঠিক হলো, পরদিন এগারোটা নাগাদ যাওয়া হবে।
সেদিন আমার সঙ্গী যেভাবে সোমেন মিত্রর দপ্তরে প্রবেশ নিয়েছিল, তাতে বুঝতে পেরেছিলাম দুজনেই বেশ কাছের মানুষ। সান্ত্বনা বলতে তখন ওটুকুই।
- আরে বসো বসো। বললেন রক্তমাংসের সোমেন মিত্র।
বুকটা তো তখন ধক করে উঠেছিল জানি। কিন্তু আমার মুখটাও কি তখন শুকিয়ে গেছিল? জানি না। তবে আমহার্স্টের 'ছোড়দা' আমায় দেখে একটু হাসলেন। সরল নিষ্পাপ বা ভদ্রতাসূচক হাসি না একেবারেই। বরং হাসির ভাষাটা ছিল যেন দুষ্টুমিতে ভরা। যেন তিনিও বললেন- কী কেমন মজা?
এরপরেই বললেন- দাঁড়িয়ে কেন, বসে পড়ুন।
স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করলাম আমিও। তিনি তখন অন্য আর একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তারও বেশ মস্তানের মতো লুক। কথা থামিয়ে সোমেনবাবু তাকে জিজ্ঞেস করলেন- চিনিস উনি কে?
আমার মুখের দিকে দুজোড়া চোখের ফোকাস টেবিলের উল্টো দিকের। আমিও কম যাই না। ছোট্ট করে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছি ঠোঁটে। সোমেন মিত্র তাঁর সেই শাগরেদকে ম্যাগাজিনের নাম করে বললেন- আমার যে কার্টুনগুলি দেখলি, সবগুলি ওর আঁকা।
ক্লাইম্যাক্সের শেষ ধাপ।
মনকে সান্ত্বনা দিতে জওহররলাল নেহরুর কথা ভাবলাম। তখন আসমুদ্র হিমাচল কংগ্রেস রাজ। কার্টুন সবসময় শাসকদের নিয়েই আঁকার রেওয়াজ। তার ওপর নেহরুর জনপ্রিয়তাও তখন তুঙ্গে। সেই নেহরুকে নিয়ে প্রায় হাজার চারেক কার্টুন এঁকে ফেলেছিলেন কেশব শঙ্কর পিল্লাই। দুনিয়া যাকে চেনে শঙ্কর নামে। কিন্তু কোনও কারণে বেশ কিছুদিন সেই ইংরেজি দৈনিকে নিজের কার্টুন চোখে পড়ছিল না নেহরুর। ডাক পড়লো কার্টুনিস্টের। নেহরু জানতে চাইলেন- আমার কি জনপ্রিয়তা কমে যাচ্ছে? এরপরেই বলেছিলেন- ডোন্ট স্পেয়ার মি শঙ্কর। আশা করলাম, সোমেন মিত্রও আমাকে সেরকম কিছু জিজ্ঞেস বলবেন।
আমার পরিচয় দিয়েই হেসে উঠলেন সোমেন মিত্র। দপ্তরের অন্যরাও তাতে যোগ দিলো। একমাত্র আমি বাদ। এবার মনে পড়ে গেল 'শোলে' সিনেমার গব্বর সিংয়ের সেই অট্টহাসি। আমি যেন কালিয়া। অপেক্ষা করছি, কখন সোমেন মিত্র বলেন- যো ডর গয়া, ও মর গয়া। না সেসব কিছু হলো না। তিনি এও বললেন না- অব গোলি খালে। বরং সোমেন মিত্র জানতে চাইলেন, কী খাবো। আর ঠিক তখনই চা হাজির।
"আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম যে আপনি শিল্পী।" হাসতে হাসতে বললেন বাংলার কংগ্রেসের মুখ। "একেবারে আমার ধুতির কাছা খুলে দিয়েছিলেন।" ততক্ষণে আমিও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছি। কোথায় থাকি, কী করি, অনেক খবরাখবর নিলেন। বেশ একটা গার্জিয়ানসুলভ হাবভাব। নেহরুজিকে আমি দেখিনি। তাঁর কার্টুনিস্টের ওপর দরাজ দিল হওয়ার কথা বইয়ে পড়েছিলাম। সোমেন মিত্রও ঠিক সেরকম কিনা তখনও জানি না। তবে ততক্ষণে আমি বুঝতে পেরে গেছি, সামনের এই ধুতি পাঞ্জাবি পরা মানুষটা আমার কোনও ক্ষতি করতে পারে না। সেমুহূর্তে আমারও ইচ্ছে করছিল, ওঁকে একবার 'ছোড়দা' বলে ডাকি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন