উৎসবের দিন প্রতিদিন

 উৎসবের কথায় আজ শয়ন একাদশী ব্রত  কথা  

 বাঙ্গালীর আর এক পার্বণ আগামীকাল ,          " শয়ন একাদশী" 



সুমগ্ন দাস 
করোনা সংক্রমণ বাড়বাড়ন্তের কারণে এবছর রথযাত্রা হল না। ফলে সোজা রথ বা উল্টো রথ শুধুই পঞ্জিকার  পাতায় রয়ে গেল। আগামীকাল আরেকটি ব্রত পালন ।শয়ন একাদশী ব্রত। প্রতিবছর উল্টোরথের পরদিন এই ব্রত পালন করা হয়। জগন্নাথ দেবেন রথের আগে হয় চন্দন যাত্রা বা স্নান যাত্রা।  এই স্নাযাত্রার পর একটু নাকি অসুস্থ হয়ে পড়েন জগন্নাথদেব। এর পর সুস্থ হয়ে সবাইকে দর্শন দেন রথযাত্রায়। 

‘উৎকলখণ্ড’ এবং ‘দেউল তোলা’ নামক ওড়িশার প্রাচীন পুঁথিতে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার ইতিহাস প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, এই রথযাত্রার প্রচলন হয়েছিল সত্যযুগে। 
আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠান শুরু করে শুক্লা একাদশীর দিন পূর্ণযাত্রা বা উল্টোরথ অনুষ্ঠিত হয় । পুরাণ মতে, প্রায় দু’হাজার বছর আগে থেকেই রথযাত্রা ও উল্টোরথ যাত্রা হয়ে আসছে ।সে সময় আজকের ওড়িশার নাম ছিল মালবদেশ। সেই মালবদেশের অবন্তীনগরী রাজ্যে সূর্যবংশীয় ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে  বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন, যিনি স্বপ্নাদেশে পেয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর এই জগন্নাথরূপী মূর্তির রথযাত্রা শুরু করার ।আর এই উল্টোরথের দিনেই বাড়ি ফেরন জগন্নাথ দেব।
জগন্নাথ দেবের এই পুর্ণযাত্রা শেষ করে আসার পর তিনি নাকি শয়নে যান। এই একাদশী তিথিতে। এই সময়ে তিনি  সাময়িক বিশ্রামে থাকেন। 

তবে শাস্ত্রমতে শয়ন একাদশী ব্রতের কথা আমাদের বারো মাসের তেরো পার্বণের তালিকায় রয়েছে। একবার দেখে নেওয়া যাক শাস্ত্রমতে শয়ন একাদশী কথা।

 


" মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন — ‘ হে কৃষ্ণ ! আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি ? এর মহিমাই বা কি ? তা আমাকে কৃপাপূর্ব্বক বলুন ।’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন , ব্রহ্মা এই একাদশী সম্পর্কে দেবর্ষি নারদকে যা বললেন । আমি সেই আশ্চর্যজনক কথা আপনাকে বলছি ।
শ্রীব্রহ্মা বললেন , হে নারদ ! এ সংসারে একাদশীর মতো পবিত্র আর কোন ব্রত নেই । সকল পাপ বিনাশের জন্য এই বিষ্ণুব্রত পালন করা একান্ত আবশ্যক । যে ব্যক্তি এই প্রকার পবিত্র পাপনাশক এবং সকল অভিষ্ট প্রদাতা একাদশী ব্রত না জেনে করে তাকে নরকগামী হতে হয় । আষাঢ়ের শুক্লপক্ষের এই একাদশী ‘ শয়নী ‘ নামে বিখ্যাত । শ্রীভগবান ঋষিকেশের জন্য এই ব্রত পালন করতে হয় । এই ব্রতের সমন্ধে এক মঙ্গলময় পৌরণিক কাহিনী আছে । আমি এখন তা বলছি ।
বহু বহু বছর পূর্বে সূর্যবংশে মান্ধাতা নামে একজন রাজর্ষি ছিলেন । তিনি ছিলেন সত্যপ্রতিজ্ঞ এবং প্রতাপশালী চক্রবর্তী রাজা। প্রজাদের তিনি নিজের সন্তানের মতো পালন করতেন । সেই রাজে্য কোন রকম দুঃখ , রোগ- ব্যাধি , দুর্ভিক্ষ , আতঙ্ক , খাদ্যভাব অথবা কোন অন্যায় আচরণ ছিল না । এইভাবে বহুদিন অতিবাহিত হলো । কিন্তু একসময় হঠাৎ দৈবদুর্বিপাকে ক্রমাগত তিনবছর সে রাজ্যে কোন বৃষ্টি হয় নি । দুর্ভিক্ষের ফলে সেখানে দেবতাদের উদ্দেশ্যে দান মন্ত্রের ‘ স্বাহা ‘ ‘ স্বাধা ‘ ইত্যাদি শব্দও বন্ধ হয়ে গেল । এমনকি বেদপাঠও ক্রমশ বন্ধ হল । তখন প্রজারা রাজার কাছে এসে বলতে লাগল — মহারাজ দয়া করে আমাদের কথা শুনুন । শাস্ত্রে জলকে নাল বলা হয় আর সেই জলে ভগবানের অয়ন অর্থাৎ নিবাস । তাই ভগবানের এক নাম নারায়ণ । মেঘরূপে ভগবান বিষ্ণু সর্বত্র বারিবর্ষণ করেন । সেই বৃষ্টি থেকে অন্ন এবং অন্ন খেয়ে প্রজাগণ জীবন ধারণ করেন । এখন সেই অন্নের অভাবে প্রজারা ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে । অতএব হে মহারাজ , আপনি এমন কোন উপায় অবলম্বন করুন যাতে আপনার রাজ্যের শান্তি এবং কল্যাণ সাধন হয় । রাজা মান্ধাতা বললেন – তোমরা ঠিকই বলেছ । অন্ন থেকে প্রজার উদ্ভব । অন্ন থেকেই প্রজার পালন । তাই অন্নের অভাবে প্রজারা বিনষ্ট হয় । আবার রাজার দোষে রাজ্য নষ্ট হয় । আমি নিজের বুদ্ধিতে আমার নিজের কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছি না । তবুও প্রজাদের কল্যাণের জন্য আমি অাপ্রাণ চেষ্টা করব ।
তারপর রাজা ব্রহ্মাকে প্রণাম করে সৈন্যসহ বনে গমন করলেন । সেখানে প্রধান প্রধান ঋষিদের আশ্রমে ভ্রমন করলেন । এভাবে তিনি ব্রহ্মার পুত্র মহাতেজস্বী অঙ্গিরা ঋষির সাক্ষাৎ লাভ করলেন । তাঁকে দর্শনমাত্রই রাজা মহানন্দে ঋষির চরণ বন্দনা করলেন । মুনিবর তাকে আশীর্বাদ ও কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন । রাজা তখন তার বনে আগমনের কারণ সবিস্তারে ঋষির কাছে জানালেন । ঋষি অঙ্গিরা কিছু সময় ধ্যানস্থ থাকার পর বলতে লাগলেন – ‘ হে রাজন ! এটি সত্যযুগ । এই যুগে সকললোক বেদ পরায়ণ এবং ব্রাহ্মণ ছাড়া অন্য তপস্যা করে না । এই নিয়ম থাকা সত্ত্বেও এব শুত্র রাজ্যে তপস্যা করছে । তার এই অকার্যের জন্যই রাজ্যের এই দুর্দশা । তাকে হত্যা করলেই সকল দোষ দূর হবে । রাজা বললেন – হে মুনিবর ! তপস্যাকারী নিরপরাধ ব্যক্তিকে আমি কিভাবে বধ করব ? আমার পক্ষে সহজসাধ্য অন্য কোন উপায় থাকলে আপনি দয়া করে আমাকে বলুন ।
তদুত্তরে মহর্ষি অঙ্গিরা বললেন – আপনি আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের শয়নী নামে প্রসিদ্ধা একাদশী ব্রত পালন করুন । এই ব্রতের প্রভাবে নিশ্চয়ই রাজ্যে বৃষ্টি হবে । এই একাদশী সর্বসিদ্ধি দাত্রী এবং সর্ব উপদ্রব নাশকারিনী । হে রাজন – প্রজা ও পরিবারবর্গ সহ আপনি এই ব্রত পালন করুন। মুনিবরের কথা শুনে রাজা নিজের প্রাসাদে ফিরে গেলেন । আষাঢ় মাস উপস্থিত হলে রাজ্যের সকল প্রজা রাজার সাথে এই একাদশী ব্রতের অনুষ্ঠান করলেন। ব্রত প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো কিছুকালের মধ্যেই অন্নভাব দূর হল । ভগবান হৃষিকেশের কৃপায় প্রজাগণ সুখী হল । এ কারণে সুখ ও মুক্তি প্রদানকারী এই উত্তম ব্রত পালন করা সকলেই অবশ্য কর্তব্য । ভবিষোত্তরপুরানে যুধিষ্ঠির -শ্রীকৃষ্ণ তথা নারদ – ব্রহ্মা সংবাদ রূপে এই মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে ।"

মন্তব্যসমূহ