দিন প্রতিদিন কালকথা

বিশিষ্ট   নিবন্ধকার  , শিল্পী ও সাংবাদিক কাজল ভট্টাচার্য এর  কলমের আঁচড় ও রেখা নিয়ে সমৃদ্ধ এই বিভাগটি।এখানে সুক্ষ্ম ব্যঞ্জনার মাঝে লুকিয়ে
 থাকবে আমাদের দিন প্রতিদিনের সমস্ত কিছুই।  আজকের টাকে সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা কেন্দ্রিক প্রতিকী  রিপোর্টাজ না বলে একটা রবিবাসরীয় ছোট গল্প বলতেই পারি। ভালো লাগলে জানাবেন কমেন্ট বক্সে।
 
।। অবলা যখন সবলা, চোরাগোপ্তা কিল হজম করে পুরুষ ।।


"মনে রাখবেন করোনা রোগের সঙ্গে আমাদের লড়তে হবে। করোনা রোগির সঙ্গে নয়।"
কমপক্ষে বিশবাঁও জলে গেল এই সতর্কবাণী।
শ্বশুর শাশুড়ি নিজের বাড়িতে ফেরায় রেগে আগুন পুত্রবধু। প্রবীন দম্পতি। ঠিকানা সল্টলেক। ছেলেবউয়ের আবদার, শ্বশুর, শাশুড়িকে তাদের স্বামী, স্ত্রীর সঙ্গে একছাদের তলায় রাখা চলবে না। পাছে ওই প্রবীণ দম্পতির কাঁধে চেপে নোভেল ভাইরাস ঘরে ঢুকে পড়ে। আহাম্মকির শাস্তি দিতে স্বামীকে বেধড়ক পেটালেন স্ত্রী।

কম যায় না গাঁয়ের বউমাও। এমনিতে শহুরেদের একটা বদনাম আছেই। কিন্তু বাস্তবে সল্টলেকের শিক্ষিত এঞ্জিনিয়ার বউমার চেয়ে নৃশংসাতে আরও কয়েক কদম এগিয়ে গেলো ঝাড়গ্রামের বউমা পানমনি টুডু। জামবনি ব্লকের ফুলবহড়া গ্রামে গত বুধবার রাতের ঘটনা। শাশুড়ির সঙ্গে খিচখিচ লেগেই থাকতো। তাই একদিন ঝগড়া লাগতেই দিলো শাশুড়ির গলা টিপে। পরদিন মৃত শাশুড়ির হাত-পা বেঁধে ভরে ফেললেন বস্তায়। সকাল হতেই বস্তাবন্দী শাশুড়ির লাশ সাইকেলে চাপিয়ে গভীর জঙ্গলে ফেলে দিয়ে এলো করিতকর্মা পুত্রবধু।
ঘটনাস্থল কলকাতার থেকে খানিক দূরে পশ্চিম মেদিনীপুরে। খবরের কাগজে ঘটনার খবর ছাপা হলেও, তা নিয়ে হইহল্লা হলো না। বলতে গেলে ওই ঘটনা অনেকেরই চোখের আড়ালে রয়ে গেল।

কিন্তু শোরগোল পড়ে গেল কলকাতার ঘটনা নিয়ে। করোনা মোকাবিলায় জনতা কার্ফিউ শুরুর আগের দিনই ছেলে, মা বাবাকে বৈদ্যবাটির আদিবাড়িতে রেখে আসে। আনলক হতেই তাদের ফের সল্টলেকে ফিরিয়ে আনে ছেলে। এঞ্জিনিয়ার বউমা ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরতেই লঙ্কাকান্ড। শ্বশুর শাশুড়িকে দেখে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে সে। মনের ঝাল ঝাড়তে চটাপট চড় পড়তে লাগলো স্বামীর গালে। লাথি কিল ঘুষি চড় থাপ্পড়ে বিধ্বস্ত স্বামী। ভাইরাল ভিডিওতে না দেখা গেলেও অভিযোগ, সিগারেটের ছ্যাঁকাও খেতে হয়েছিল স্বামীকে। স্ত্রীর সন্দেহ, শ্বশুর শাশুড়িকে এনে বাড়িতে করোনা ঢুকিয়েছে স্বামী। ব্যাস আর যায় কোথায় মাতৃপিতৃভক্ত ছেলে! বউয়ের ধাক্কায় ছিটকে পড়লো স্বামী। অনুনয় বিননয় ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কে শোনে কার কথা?
একতরফা বউয়ের হাতে পিটুনি খেয়ে কাহিল বেচারা স্বামী।

ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ওই ছবি দেখে অনেক মহিলাই অট্টহাসে ফেটে পড়েছেন। আবার অনেকে বলেছেন বেচারা স্বামী। স্ত্রীদের উল্লাস দেখে, পাশ থেকে স্বামীরা কখন যেন কেটে পড়েছিলেন। ওই দৃশ্য তাঁরা মুখবুজে হজম করতে পারেননি। রাগে ফুঁসতে থাকা স্বামীরা চাপাস্বরে একখানা খিস্তি ঝেড়ে, বাইরে গিয়ে সিগারেটে আগুন দিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, অধিকাংশ স্বামীই কিন্তু সেই মাস্তান স্ত্রীকে খিস্তি মারেননি। খিস্তি দিয়েছিলেন ওই অবলা স্বামী নামক পুরুষটিকে। এছাড়া আর কিই বা করতে পারতেন?

"বেশ করেছে বরকে পিটিয়ে।" সোশাল মিডিয়ায় এধরনের বেশকিছু কমেন্ট করেছেন মহিলারা। "মেরে মাজা ভেঙে দিলে আরও ভালো হতো।" গোটা ঘটনাটাকে দেখানো হচ্ছে বদলার রংয়ে চুবিয়ে। যুক্তিটা এরকম, এতদিন পুরুষরা একতরফা বউ পিটিয়েছে। এখন সেই ঘটনাই বুমেরাং হয়ে ফিরেছে। যার শিকার সল্টলেকের ওই স্বামী। মোদ্দা কথা, স্বামী পেটানোয় সরাসরি উৎসাহ জুগিয়েছেন সোশাল মিডিয়ায় দারুণ সক্রিয় ওই মহিলারা।
পাল্টা বাক্যবাণ ছুঁড়েছেন পুরুষরাও। তাঁদের মত, পুরুষের নিরাপত্তার ভার নিজেদের হাতেই তুলে নিতে হবে পুরুষদেরই। মারের বদলা মার। এরইমধ্যে বেশকিছু মহিলা আছেন, যাঁরা সরাসরী স্বামী পেটানোর ঘটনার নিন্দা করেছেন। অসহায়তা ব্যক্ত করেছেন অনেক পুরুষ। আঙুল তুলেছেন দেশের আইনকানুনের দিকে।

বউপেটালেই হাতে হাতকড়ি। বরপেটালে সেরকম কোনও ভয় নেই।
পেটাই হওয়া স্বামীর অভিজ্ঞতা এরকমটাই। নিজের মুখে সেকথাই জানিয়েছিলেন তিনি। পুলিসের কাছে ছুটেছিলেন জখম হওয়া স্বামী। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। তাঁর বক্তব্য, এফআইআর নেয়নি বিধাননগর নর্থ থানা। উল্টো তাঁকে ভয় দেখিয়েছেন পুলিসকর্তা। বলা হয়েছে, দেশের আইনকানুন সবই নাকি মহিলাদের পক্ষে। সুতরাং তারা ওই অভিযোগকারী নির্যাতীত স্বামীর জন্য আলাদা করে কিছু করতে পারবে না।

সল্টলেকের ওই ঘটনায় অভিযুক্ত বউমা শুধু যে স্বামীকে নির্যাতন করেছেন তা নয়। পাশাপাশি আর এক মারাত্মক অপরাধও করে ফেলেছেন তিনি। আর সেই অপরাধ নিছক মানবিক না, বেআইনিও বটে। ওই মহিলা সরাসরি ছিনতাই করতে চেষ্টা করেছেন তাঁর শ্বশুর শাশুড়ির আইনি অধিকার। প্রবীণ ওই দম্পতি আইনগত ভাবেই থাকতে পারেন বিবাহিত ছেলের সংসারে। মারমুখী ওই বউমা দেশের আইনকানুনের কোনও খবর রাখেন না এমনটাও অসম্ভব।
সরকারের তরফ থেকেও বারেবারে প্রচার চালানো হয়েছে, করোনা রোগীদের অস্পৃশ্য মনে না করার জন্য। ছেলের দাবি, মা বাবা দুজনের কাছেই মেডিক্যাল ফিট সার্টিফিকেট ছিলো। কিন্তু কোনও কিছুতেই কর্ণপাত করতে রাজি না বউমা। তাঁর এরকম বেপরোয়া হওয়ার জন্য সবাই প্রথমেই কাঠগড়ায় তুলেছেন পুলিস প্রশাসনকে। আঙুল উঠেছে দেশের আইনকানুনের দিকেও। সবারই মত, লিঙ্গবৈষম্য দোষে দুষ্ট আইন। বৈষম্য দূর না করতে পারলে পুরুষের অবস্থা আরও সঙ্গীন হবে।

পুলিসের কাছে মদত না পেয়ে, নির্যাতীত স্বামীর শেষ ভরসা আদালত। তাঁর আইনজীবী অবশ্য ভরসা দিয়েছেন নিরপেক্ষ বিচারের। দেশের আইন একতরফা মহিলার পক্ষে, এমন অভিযোগ তিনি মানতে চাননি। তবে সাধারন মানুষের অভিজ্ঞতা কিন্তু উল্টোটাই। পুলিসের নিষ্ক্রিয়তাও সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু এসবের চেয়েও বড়কথা, বউয়ের হাতে মার খেয়ে ঠিক কজন স্বামী পুলিসের কাছে ছোটার মতো মানসিকতা রাখেন? কজনই বা ক্ষমতা রাখেন আদালতে ছুটতে? তবে শাশুড়িকে খুনের অভিযোগে বউমা পানমনিকে গ্রেপ্তার করেছে জামবনি পুলিস।

এবার ভাবুন তো, সল্টলেকের ওই ঘটনায় স্বামীও যদি স্ত্রীকে পাল্টা মার দিতেন? সব স্বামীরাই অমন নিরীহ হবে, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। অবধারিত ভাবেই পুলিসের দ্বারস্থ হতেন স্ত্রী। স্বামীর কোমড়ে দড়ি পড়ানোর আগে একবারের জন্যও ভাবতো না পুলিস। এমনকি শ্বশুর শাশুড়িকেও পাকড়াও করতে পারতো। অভিযুক্ত স্বামীর ফাঁসির দাবিতে ধর্নায় বসতো নারী আন্দোলনের প্রবক্তা মহিলা সংগঠন, মানবাধিকার কর্মীরা। বুদ্ধিজীবীরা মোমবাতি মিছিল করতেন। দাবি উঠতো শ্বশুর শাশুড়ির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। মিডিয়ার ক্যামেরা, থানা থেকে পুলিসসের ভ্যানে চেপে পাকড়াও হওয়া স্বামীর আদালতযাত্রার লাইভ কভারেজ। খবরের শিরোনাম। সন্ধ্যা হলেই 'ঘণ্টাখানেক' বিদ্বজ্জন, মনোবিদ, অপরাধ বিশেষজ্ঞদের আলাপ আলোচনা। কোন রাজনৈতিক দলের উত্থানে মনুবাদ, পুরুষতন্ত্র ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ঢুকে পড়তো মতলববাজ রাজনীতি। আদালতের বিচারের আগেই অভিযুক্তের বিচার করে ফেলতেন সমাজের দন্ডমুন্ডের কর্তারা।

কিন্তু এবার ঘটনার স্রোত বিপরীত। তাই সবার মুখে তালা। ওই বেপরোয়া মহিলাদের, কলকাতার বা পশ্চিম মেদিনীপুরের, শাস্তির দাবিতে কোনও কোনও আওয়াজ ওঠেনি। খাতাকলমে পুরুষ সংগঠন আছে। কিন্তু তা খায় না মাখে বোঝা ভার।

সল্টলেক বা মেদিনীপুরের ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন বা 'রেয়ার অফ দ্য রেয়ারেস্ট' ভাবারও কোনও কারণ নেই। মনুয়াকান্ডের স্মৃতি আজও হয়তো অনেকের মনে আছে। পরকীয়ার বলি হয়েছিল স্বামী। প্রেমিকের সঙ্গে যোগসাজশে স্ত্রী খুন করিয়েছিল স্বামীকে। অপরাধের জগতে ক্রমেই জড়িয়ে পড়ছে নারীরা। আইন প্রণেতারা যে চোখকান বুজে আছেন, এমনটাও নয়। চারশো আটানব্বই ধারা সংশোধন করেই স্পষ্ট সঙ্কেত দেওয়া হয়েছিল।

তবে এক চরম বাস্তব সত্য মনে রাখা জরুরি। যে কোন তোষননীতির পরিণামই ভয়ঙ্কর। তা সে ধর্ম লিঙ্গ জাতপাত দুর্নীতি যাই হোক না কেন।

মন্তব্যসমূহ